সরকারি নীতি ও কৌশল বাস্তবায়ন নিয়ে কথা

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। ফাইল ছবি

আমাদের বেশ কিছুদিন অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। কিছু চ্যালেঞ্জ অভ্যন্তরীণ, কিছু বহির্বিশ্বের। কিছু কভিড আসার পর হয়েছে। কিছু চ্যালেঞ্জ এসেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমরা এসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি। এখন আমাদের দরকার সে চ্যালেঞ্জগুলো উত্তরণ করে কিভাবে এগিয়ে যাব। নানা সময়ে নানা প্রসঙ্গে এগুলো আমরা আলোচনা করেছি। কিছুদিন আগে আইএমএফ এসেছে।

universel cardiac hospital

বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু সংস্কারের শর্ত দিয়েছে। যেমন—মূল্যস্ফীতি কমানো, কর ব্যবস্থা ঠিক করা, ব্যাংকিং খাত ঠিক করা, জ্বালানি পলিসি করা, জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ করা। কৃষিতে ভর্তুকি নিয়ে কথা বলেছে। এসব নিয়ে আমাদের দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিজ্ঞজনরাও কথা বলেছেন।

এখন আরো কতগুলো সমস্যা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় আমাদের নীতি কী হবে? এবং সেগুলো বাস্তবায়নের কৌশলগুলো কী? একটা কথা প্রথমে বলে রাখি, কয়েক দিন যাবৎ যে অবস্থার মধ্যে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, সেটা দুঃসহ। বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই, কয়লা নেই; নানা সমস্যা। এই সমস্যাগুলো কিন্তু হঠাৎ করে উদ্ভব হয়নি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো হঠাৎ করে হলো, সেটা তো নয়।

এটা আগে থেকে দেখতে হবে। নীতিনির্ধারক, রাজনীতিবিদ, সরকারের সংশ্লিষ্ট মানুষদের আগে থেকে বুঝতে হবে, ভবিষ্যতেও আমরা এমন আরো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হব। আমি মনে করি, সব লিগ্যাসি প্রবলেম। লিগ্যাসি মানে ঐতিহাসিকভাবে আমাদের কিছু ভুল নীতি, ভুল কৌশল এবং সেটার বাস্তবায়ন দুর্বলতা। এর মধ্যে কিছু কিছু ভালো উদ্যোগ ছিল, সেগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে। সব মিলিয়ে আমি বলব, এটা প্রথমত পলিসির ব্যর্থতা। দ্বিতীয়ত, বাস্তবায়নে ব্যর্থতা। তৃতীয়ত, এগুলোর মনিটরিং ও মূল্যায়ন করা হয়নি। এর ফলে এ রকম হয়েছে।

মূল্যস্ফীতির ব্যাপারটা ধরা যাক। আমরা দেখেছি কভিডের সময় ইন্ডাস্ট্রিগুলোর ওপর নানা প্রভাব পড়েছে। মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে আমাদের সরবরাহ বাড়াতে হবে। পণ্যের সেবাগুলো ঠিকভাবে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। বাইরে থেকে আমদানি করতে হলে করব। ভেতর থেকে উৎপাদন করতে হলে করতে হবে। ভেতরে যারা উৎপাদন করে, সেই কৃষকদের ন্যায্য দাম দেব। বাজার নিয়ন্ত্রণ করব। বাজারে যেন সিন্ডিকেট না থাকে, সেদিকে নজর দেব। এগুলো যথাসময়ে করা হয়নি। তারপর দেশে খাদ্যপণ্য, সয়াবিন তেল, চিনি, ডাল—এগুলোর দাম বেড়েছে। এতে মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভবান হচ্ছে।

আমরা পলিসিটাও ঠিক ভালোভাবে নিতে পারিনি। হঠাৎ রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। আমদানি বেড়ে গেছে। রপ্তানি কমে গেছে। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক বলল, চারটি রেট করি। আমদানি কন্ট্রোল করি। কিন্তু বিপদটা যে আসছে, এটা কিন্তু আগে থেকে আমাদের ফোকাস করা উচিত ছিল। এটা তো নীতিনির্ধারকদের মূল বিষয়। তারা তথ্য নেবে। তারা গবেষণা করবে। তারা নিজেরা গবেষণা করবে অথবা গবেষণার ফলাফল নেবে। লোকজনের সঙ্গে আলাপ করবে। সেটা তো করা হয়নি। সে জন্য সমস্যা দ্রুত জটিল হয়ে গেছে।

অতএব মূল বিষয় হলো, হঠাৎ পলিসি করা ঠিক নয়। যে পলিসিগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিল, ইমপোর্ট কমাল, রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য চারটি রেট করল; এতে এক্সপোর্টও বাড়েনি। রেমিট্যান্সও বাড়েনি। হুন্ডির দৌরাত্ম্যও কমেনি। আর এদিকে ইমপোর্ট কিছুটা কমেছে। তবে ইমপোর্ট একবারে কমিয়ে দেওয়া যাবে না। অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে সমস্যার গভীরে গিয়ে তথ্য-উপাত্ত এবং নিজস্ব অভিজ্ঞতা/জ্ঞানের ভিত্তিতে নীতিনির্ধারকরা পলিসি নেবে, সেটাই উত্তম উপায়।

দ্বিতীয়ত, আমরা দেখি ব্যাংকিং খাত। ব্যাংকিং সেক্টরের কথা বারবার বলা হচ্ছে। ব্যাংকিং সেক্টরে সমস্যা, লুটপাট, খেলাপি ঋণ, ঋণ ডাইভারশন, বড় বড় কম্পানির কাছে জিম্মি, ছোট-মাঝারি শিল্পে যথাযথ ঋণ না দেওয়া—এগুলো প্রায় সবাই জানেন। তাহলে শিল্পের কী অবস্থা! ছোট শিল্প, মাঝারি শিল্প—তারাও পণ্য উৎপাদন করে, কর্মসংস্থান করে। ফলটা কী হলো, কর্মসংস্থান কম। লোকজন বেকার বসে আছে। আয়ের সংস্থান নেই। আবার ওদিকে পণ্য উৎপাদন হচ্ছে না। পণ্য উৎপাদন শুধু কৃষিপণ্য বলছি না। অনেক ধরনের পণ্য বাজারে আসে। যেগুলো বাজারে আদান-প্রদান হয়। রিয়াল গুডস ও সার্ভিসেস যেটা বলি। আসল পণ্যের কথা বলছি। একটা রুটি তৈরি করলাম। একটা বিস্কুট তৈরি করলাম। লোকজনের অত্যাবশ্যকীয় নানা রকম জিনিস—বাজারে এগুলো না আসার কারণে আবশ্যকীয়ভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। সরবরাহ যদি কম হয় আর ডিমান্ড কিছু কিছু বাড়ে। সুতরাং ব্যাংক থেকে ছোট ও মাঝারি শিল্পে ঋণ দিতে হবে।

সম্প্রতি আমি দেখছি, কেউ কেউ বলছেন, মূল্যস্ফীতিটা সরবরাহজনিত কারণে হচ্ছে। সরবরাহজনিত কারণ মানে আমরা বলি ‘ইমপোর্টেট ইনফ্লেশন’। খাদ্যদ্রব্য আনছি, সয়াবিন তেল আনছি, পেট্রোলিয়াম আনছি, যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আনছি; সেগুলোর দাম বেড়ে যাচ্ছে। এসব পণ্যের তো অনেক আগে দাম বেড়েছে। কৃষিপণ্য, ডিজেল, পেট্রোলিয়াম, এলএনজি গ্যাস—সবগুলোর দাম তো নিচের দিকে। কয়লা নিয়ে হৈচৈ হচ্ছে, কয়লার দাম তো এখন অনেক কম। তাহলে এটা কি করে বলে যে শুধুই ইমপোর্টেট ইনফ্লেশন? মূল সমস্যা হলো আমাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। দক্ষতার অভাব। নিষ্ঠা ও সততার অভাবে দেশের এ রকম অবস্থা। দেশের কর্মকাণ্ড উজ্জীবিত করার জন্য উদ্ভাবনীমূলক উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল। ছিটেফোঁটা যা নীতিমালা আছে, তা আবার প্রয়োগ করা হয় না।

এনবিআর বারবার বলছে যে ট্যাক্স নেট বাড়াবে। এনবিআরকে আমি আবার দোষ দিই না। তাদের ওপর যারা নীতিনির্ধারক, তারা কী করেছে? তারা কি এনবিআরকে সহায়তা করেছে? তাদের কি বলেছে, এটা করো? তাদের কি মূল্যায়ন করেছে?

শুনলাম, কিছু কিছু দোকানকে নাকি অটোমেটিক ক্যাশ রেজিস্টার দিয়েছে। কয়েকটি দোকানে হয়তো ক্যাশ রেজিস্টার আছে, কিন্তু আশপাশের পাঁচটা দোকানে নেই। একটা দোকানে দেবেন, পাঁচটা দোকানে দেবেন না—এটা তো সম্পূর্ণভাবে অযৌক্তিক। বাইরের দেশের দোকানে গেলে দেখা যায়, সেখানে ক্যাশ রেজিস্টার আছে। ঢাকায়ও বড় বড় দোকানে আছে, কিন্তু অন্যখানে কি আছে এগুলো? লম্বা একটা সাদা কাগজে ক্যাশমেমো লিখে দিয়ে দেয়।

জ্বালানি খাতে হুট করে দাম বাড়িয়ে দেওয়া হলো। অকটেনের দাম একেবারে ৪০ থেকে ৫০ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হলো। গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হলো। এত দিন যখন দেখছেন, বাইরের দেশে গ্যাসের দাম বাড়ছে, তখন কেন বাড়াননি? অকটেন ৮৯ থেকে ১৪২ টাকা—অদ্ভুত ব্যাপার। পৃথিবীর কোনো দেশেই এরকমভাবে বাড়ানো হয় না।

কিভাবে ব্যবসায়ীরা অ্যাডজাস্টমেন্ট করবে? কিভাবে সাধারণ মানুষ অ্যাডজাস্ট করবে? একটা জিনিসের দাম ধীরে ধীরে বাড়তে থাকলে প্রক্ষেপণ করে, প্রজেক্ট করে; আচ্ছা এখন তো দাম বেড়ে গেছে, অন্য জিনিসে পাঁচ টাকা সাশ্রয় করে এটা ঠিক করে নেব। হঠাৎ বাড়িয়ে দিলে তো সমস্যা।

এত দিন ফরেন এক্সচেঞ্জ কন্ট্রোল করেননি। ৭৫, ৮০, সেখান থেকে ৮২ ছিল। হঠাৎ ১০৭। হঠাৎ টাকার এত বড় অবমূল্যায়ন সব ব্যবসায়ী ও জনসাধারণকে বড় রকমের সমস্যায় ফেলে দিয়েছে।

এই যে এখন বিদ্যুতের ব্যাপার—বহু রকম ঢাকঢোল পিটিয়ে বিদ্যুতের ব্যাপার বলা হলো, কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট, এই সেই ব্যাপার; আগে থেকে কেন আপনারা প্রজেক্ট করলেন না, কী রকম তেল দরকার? কী রকম ডিজেল দরকার, জ্বালানি দরকার, গ্যাস দরকার? কয়লা সরবরাহটা আপনি আগে থেকে প্রজেক্ট করলেন না কেন? জানেন এ পরিস্থিতি হচ্ছে, তাহলে আগে থেকে সংগ্রহ করেননি কেন? হঠাৎ করে তো আনা যাবে না। এটা এমন না যে আপনি ট্রাকে করে নিয়ে আসবেন? হ্যাঁ, আপনি ট্রাকে করে পাশের দেশ থেকে আনতে পারবেন। এটা যে এখন এক্সপ্লোর করা যাবে, তাও দেখছি না। এটা তো এতই ইমার্জেন্সি যে আমরা যে তাদের প্রতিবেশী দেশ, বন্ধুসুলভ দেশ বলছি, ওদের থেকে আপনি কয়লা আনেন না কেন? স্পেশাল অ্যারেঞ্জমেন্ট করেন।

আরেকটা সমস্যা, পাওনা পরিশোধ। এত দিন পাওনা ছিল যারা, এক্সপোর্ট করেছে, আমাদের এখানে কয়লা পাঠিয়েছে, জ্বালানি পাঠিয়েছে; তারা বিলটা পায়নি। পাওনা পরিশোধে ডলারের সংস্থান করা যায়নি। যতটুকু করা যাচ্ছে, তাও টাকার হিসাবে আগের চেয়ে বেশি দামে।

যেসব ব্যক্তি দায়িত্বে আছেন, সময়মতো পদক্ষেপ তাঁরা নেননি। তাঁরা শুধু দেখছেন, কার নির্দেশ আসবে, এটা করব। ভয় পাচ্ছেন। অতএব এখানে মূল সমস্যা হলো, এখানে গভর্ন্যান্স নেই। ট্রান্সপারেন্সি অ্যাকাউন্টেবিলিটি নেই। স্বচ্ছতা নেই। জবাবদিহি নেই। যার দায়িত্ব আছে, সে দায়িত্ব পালন করে না। পালন না করলে কোনো শাস্তি হবে না। কেউ পালন করতে গিয়ে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে তার ওপর সবাই চেপে বসবে। তার হয়তো কোনো কারণে ত্রুটি-বিচ্যুতি হতে পারে, কিন্তু লোকজনের তো কাজ করতে হবে।

এখন আসি বাজেটে। আমরা ভেবেছিলাম একটা বাস্তবসম্মত বিশেষ সময়ের জন্য একটা বিশেষ বাজেট হবে। তার বদলে গতানুগতিক ধারার একটি বাজেট পেলাম। আশার কথা আছে, রূপকল্প আছে বাজেটে, কিন্তু নির্দিষ্ট কৌশল, কর্মসূচি ও যথাযথ অর্থের বরাদ্দ তেমন দেখিনি।

এখন সর্বশেষ আমি যেটা বলি, এখানে সবচেয়ে বড় গরজ হলো সময়মতো পলিসিগুলো নেওয়া। এনার্জি পলিসি নিয়ে বহুদিন কথাবার্তা হয়েছে। নিজস্ব কয়লা আছে। গ্যাস এক্সপ্লোর করব অফশোরে, সেটা নিয়েও পলিসি নেওয়া হয়নি। তিতাস, বাখরাবাদ গ্যাস ফিল্ড সেগুলো সার্ভিসিং করতে হবে। কোনো পলিসি নেই। কতগুলো প্রগ্রাম আছে, কতগুলো প্রজেক্ট আছে, কিন্তু সেগুলোও সময়মতো বাস্তবায়িত হচ্ছে না।

সর্বশেষ হলো, ভালো লোককে সামনে আনা হচ্ছে না। সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। খারাপ লোকজন আসছে, খারাপ কাজ করে চলে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে আমি বলব, নীতির ক্ষেত্রে ভুল, কৌশল, স্ট্র্যাটেজি, প্রগ্রাম, প্রকল্প এবং বিভিন্ন প্রজেক্ট প্রণয়নের ব্যাপারে ভুল রয়ে গেছে। অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয় না। এতে দেশ, জনগণ, বাণিজ্য, শিল্প, সামাজিক উন্নয়ন, জীবনধারার মান—এগুলোর ওপর তেমন ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে না।

বাংলাদেশ এখন সব কিছু মিলিয়ে ঐতিহাসিক কারণে, ভুল সিদ্ধান্ত ও ভুল চিন্তার কারণে আর কিছু বহির্বিশ্বের সমস্যার কারণে আজকের সমস্যাপূর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। আমাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা যদি সমাধান হয়ে যায়, অনেক কিছু সহজ হয়ে যাবে। বাইরের জগতের অস্থিরতার ওপরই বেশি দোষ চাপানো সঠিক নয়। আমরা বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছি। এ রকম চ্যালেঞ্জের মুখে বাংলাদেশ অনেক দিন পড়েনি।

লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

অনুলিখন : রায়হান রাশেদ

শেয়ার করুন