যেভাবে পঙ্কিল গর্তে রাজনীতি

আবদুল মান্নান

আবদুল মান্নান
আবদুল মান্নান। ফাইল ছবি

বরেণ্য শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কিছুদিন আগে দেশের একটি দৈনিকে লেখা তাঁর প্রবন্ধে প্রশ্ন রেখেছেন, দেশের রাজনীতির প্রতি অনাস্থা বাড়ল কেন? তাঁর লেখাটি ছিল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। ওবায়দুল কাদের বেশ আগে জাতীয় পার্টির ত্রিবার্ষিক কাউন্সিলে বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগ দিয়ে বলেছিলেন, ‘রাজনীতিতে ভালো মানুষ আসতে চায় না। আমরা রাজনীতিকে ভালো মানুষের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলতে পারিনি, যে কারণে আজ ভালো, শিক্ষিত, সৎ ও যোগ্য মানুষ রাজনীতির ধারেকাছেও নেই। একই অবস্থা ছাত্ররাজনীতির।

’ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখাটির অনেকটা জুড়ে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, বাস্তব কারণগুলো খুঁজে পাওয়া একটু কঠিন। তিনি আমার একজন অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। তাঁর বিশ্লেষণ নিয়ে কোনো মন্তব্য না করেও রাজনীতির এই হালের জন্য কিছু বাস্তব কারণের অনুসন্ধান করা যেতে পারে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর বাংলাদেশে অনেক কিছুই সেনাশাসক জিয়ার হাত ধরে অশুদ্ধ হয়েছে।

universel cardiac hospital

জিয়ার অবৈধ ক্ষমতা দখলকে বৈধ করার জন্য তাঁর কিছু তাঁবেদার ও লোভী মানুষের সমর্থন প্রয়োজন ছিল, যা পেতে তাঁকে খুব কষ্ট করতে হয়নি। প্রথমে তাঁর তাঁবেদার হয়ে আসেন বঙ্গবন্ধুর কিছু কাছের মানুষ, যাঁরা ক্ষমতা আর লোভের মোহ ত্যাগ করতে পারেননি। অথচ দল ও নেতার প্রতি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অনুগত ছিলেন জাতীয় চার নেতা। যাঁরা ক্ষমতা আর অর্থের লোভে সেনাশাসক জিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন, তাঁরাই ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির প্রথম নষ্ট চরিত্র।

নিজ দলকে ভারী করার জন্য জিয়া তাঁর কাছে টেনে এনেছিলেন সামরিক-বেসামরিক আমলা আর বেশ কিছু পেশাজীবীকে। যাঁদের তিনি তাঁর দলে ভিড়িয়েছিলেন তাঁদের অনেকেই ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী। অনেকে ছিলেন সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ। আশ্রয় পেয়েছিল অনেক চরমপন্থী রাজনৈতিক দল, এসেছিলেন চরম বামপন্থী দলের নেতারা। সঙ্গে এসেছিলেন কট্টর মৌলবাদী নেতারা।

তিনি ক্ষমতায় থেকে সেনা গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করে জন্ম দিয়েছিলেন বিএনপি নামক এক রাজনৈতিক দল, যা সব সংজ্ঞায় রাজনৈতিক দলের চেয়ে ছিল নানা মতবাদের ধারক ব্যক্তিদের একটি ক্লাব। রাজনীতিতে প্রবেশ ঘটেছিল কালো টাকা আর পেশিশক্তির। তিনি নিজের স্বার্থে সংবিধানকে দর্জির মতো কাটাছেঁড়া করেছিলেন। সেখানেই তিনি থেমে থাকেননি। জিয়া সেই ব্যক্তি, যিনি দেশের নির্বাচনব্যবস্থাকে তছনছ করে দিয়েছিলেন। একাধারে রাষ্ট্রের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে তিনি এক ভয়াবহ নজির সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর নজর পড়েছিল দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের ওপর। ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি জিয়া গঠন করেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। ১৯৮১ সালের ১৯ জানুয়ারি জিয়া জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতাকর্মী ও একদল মেধাবী শিক্ষার্থী নিয়ে সমুদ্রগামী জাহাজ ‘হিজবুল বাহার’ নিয়ে বিলাস ভ্রমণে বের হন। সঙ্গে ছিলেন কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যাঁদের অনেকেই পরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। তাঁদের একজনকে সম্প্রতি বগুড়ায় দলের এক সভায় দেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। তিনি তাঁর ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হলের প্রথম সহসভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।

হিজবুল বাহারের ভ্রমণবিলাসটি ২১ জানুয়ারি শেষ হয়। এই কয়েক দিনে জিয়া এই মেধাবী শিক্ষার্থীদের অপরাজনীতির মন্ত্রে দীক্ষিত করেন। এই ছাত্রদলের নেতারাই পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দখল করেন। তখন ছাত্রলীগ অনেকটা অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে। ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে প্রতিটা ক্যাম্পাস হয়ে উঠেছিল রণক্ষেত্র। তাঁদের অনেকেই পরবর্তী সময়ে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়েছিলেন। জিয়ার সময়কালে দেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের বদলে তার ক্রমাবনতি হয়েছে। জিয়া ক্ষমতা দখল করে তাঁর এক বক্তব্যে বলেছিলেন, তিনি রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে দেবেন। এ-ও বলেছিলেন, অর্থ কোনো সমস্যা নয়। তিনি তাঁর এই দুটি কথা সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছিলেন। তাঁর আমলে রাজনীতিবিদরা সুষ্ঠু রাজনীতি করতে পারেননি। শুরু হয়েছিল রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন। দলের জন্য চাঁদাবাজি তিনি হালাল করে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতি এই পঙ্কিল গর্ত থেকে আর কখনো তেমন একটা উঠে দাঁড়াতে পারেনি।

জিয়ার পর এলেন তাঁর আরেক উত্তরসূরি জেনারেল এরশাদ, বাংলাদেশের দ্বিতীয় সেনাশাসক। তিনিও তাঁর পূর্বসূরি জিয়ার পথে হেঁটেছেন। জিয়ার পথ ধরে জন্ম দিয়েছিলেন জাতীয় পার্টির। বেশ কিছু দলছুট সন্ত্রাসী নিয়ে গঠন করেছিলেন জাতীয় ছাত্র সমাজের। তারা ছাত্রদলের চেয়ে আরো এক কাঠি সরেস। পতাকা উড়িয়ে তারা ক্যাম্পাস দখল করত। তাদের গুলিতে মারা পড়েছিল পুলিশের সার্জেন্ট ফরহাদ।

নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের তোড়ে ভেসে গিয়েছিলেন এরশাদ। সেই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল এই দেশের ছাত্রসংগঠনগুলো। তখন একটি সম্ভাবনা ছিল দেশের রাজনীতি শুদ্ধ হওয়ার, তা হয়নি। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে সব নির্বাচনী এলাকায় বিএনপির ৩০০ জন প্রার্থী দেওয়ার সক্ষমতা ছিল না। দলে ভিড়িয়ে নিয়েছিল বেশ কিছু নষ্ট হয়ে যাওয়া সামরিক-বেসামরিক আমলা, যাঁরা শেখ হাসিনার দরজায় কড়া নেড়ে বিফল হয়ে খালেদা জিয়ার শিবিরে ভিড়েছিলেন। বিএনপি প্রার্থী ঘাটতি মেটাতে দলে টেনেছিল ধনী ব্যবসায়ীদের, রাজনীতির সঙ্গে যাঁদের কোনো সম্পৃক্ততা কখনো ছিল না। অনুপ্রবেশ হয়েছিল পেশিশক্তির। তখন থেকে রাজনীতি বাস্তবে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে ব্যবসায়ী আর আমলাদের দখলে চলে যায়।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে পরিস্থিতির বড় কোনো উন্নতি হয়নি। ধীরে ধীরে ব্যবসায়ী আর অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের দৌরাত্ম্য বাড়তে থাকে দেশের রাজনীতিতে। বর্তমান সরকারের তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার ফলে যেমন বদলে গেছে দেশের চেহারা, তেমনি বদলে গেছে রাজনীতি। রাজনীতিটা আর শুদ্ধ হতে পারেনি।

ফিরে আসি গোড়ার কথায়। ‘রাজনীতিতে এখন ভালো মানুষ আসতে চায় না।…’ ওবায়দুল কাদেরের এই মন্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করার কোনো অবকাশ নেই। আর এই পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়া। সেই ধারাবাহিকতায় এখন পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরো খারাপ হয়েছে। কালো টাকা আর পেশিশক্তি এখন রাজনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। সপ্তদশ শতকের ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথের অর্থমন্ত্রী ছিলেন স্যার টমাস গ্রেসাম। অর্থনীতিতে তাঁর একটি তত্ত্ব আছে, যাতে বলা হয়েছে, ‘খারাপ মুদ্রা ভালো মুদ্রাকে বাজার থেকে বের করে দেয়।’ ওই সময় ব্রিটেনে সোনার মুদ্রা চালু ছিল। মানুষ নতুন সোনার মুদ্রা ব্যবহার না করে পুরনো মুদ্রা ব্যবহার করত।

সেই সূত্র এখন সব দেশের রাজনীতিতে চলমান। এখন রাজনীতিতে সৎ, মার্জিত ও শিক্ষিত মানুষের বড় অভাব। এই দেশের রাজনীতিতে এখন একজন বঙ্গবন্ধুর কথা বাদই দিলাম, একজন তাজউদ্দীনের কি দেখা মিলবে? কিন্তু খন্দকার মোশতাক আছে অসংখ্য। অতীতে রাজনীতিতে উত্তরাধিকার সংস্কৃতি ছিল না, যা এখন এ দেশের রাজনীতিতে বেশ দৃশ্যমান। একজন ত্যাগী রাজনীতিবিদের সন্তান রাজনীতি করবেন তাতে কোনো আপত্তি নেই, যদি তাঁর যোগ্যতা থাকে। কিন্তু যিনি জীবনেও কোনো দিন রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক রাখেননি তাঁকে যখন রাজনীতিতে টেনে আনা হয়, তখনই রাজনীতির বারোটা বাজে। আর সেই ব্যক্তি যদি কোনো পদ-পদবি পেয়ে যান, তাহলে তো কথাই নেই। বর্তমান রাজনীতিতে তৃণমূলের কর্মীদের তেমন কোনো স্থান নেই। যার বিত্ত-বৈভব আর পেশিশক্তি আছে, তিনি এখন রাজনীতিতে মূল্যবান। রাজনীতিতে এখন দুর্নীতির বরপুত্রদের বেশ কদর।

রাজনীতিতে যে সংস্কৃতি জিয়া শুরু করেছিলেন তা এখনো চলমান। বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমানে যে করুণ দশা তার আদি পিতা এ দেশের প্রথম সেনাশাসক জেনারেল জিয়া। তা জানার জন্য কোনো বড় গবেষক হওয়ার প্রয়োজন নেই।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

শেয়ার করুন