ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। যা নিয়ে উদ্বেগের অন্ত নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, এ বছর মহামারি আকার ধারণ করতে পারে ডেঙ্গুজ্বর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩ হাজার ৪৩২ জন। এর মধ্যে ৭৭ শতাংশ রোগী ঢাকা শহরের। বাকি ২৩ শতাংশ ঢাকা জেলা এবং দেশের বাকি বিভাগ, জেলা ও উপজেলার।
আর শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ৪৭৭ জন নতুন রোগী ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
অন্যদিকে, শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে তিনজনই ঢাকা শহরের।
তবে এই হিসাবের মধ্যে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরের ডেঙ্গু আক্রান্তদের তথ্য নেই। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, এ বছর এক হাজারের বেশি রোহিঙ্গা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম জানিয়েছে, শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চলতি বছর ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে চলতি মাসের প্রথম ১৬ দিনে।
গত ২৮ মে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সংবাদ সম্মেলন করে চলতি বছর ডেঙ্গুর ভয়াবহতার বিষয়ে জানান দেয়। ডেঙ্গু আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ১১ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। আর ডেঙ্গু চিকিৎসায় প্রস্তুত করা হয় হাসপাতালগুলোকে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ‘এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের বেশি মৃত্যু হচ্ছে ‘শক সিনড্রোমে’।
‘শক সিনড্রোম’ মানে হচ্ছে- ডেঙ্গু রোগীর রক্তচাপ অতিদ্রুত কমে যায়, রক্তে অণুচক্রিকার পরিমাণ কমে যায় এবং রোগীর পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হয়ে পড়ে, রোগী অচেতন হয়ে পড়েন।
এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডেঙ্গুবাহী ‘এডিস’ মশা নিয়ন্ত্রণে বাসা-বাড়ির বারান্দা, ছাদসহ বিভিন্ন স্থানে থাকা ফুলের টব বা পানি জমে মশা বংশ বিস্তার করতে পারে- এমন পাত্র পরিস্কার রাখা, মশারি টানানোসহ সার্বিক সচেতনতা অবলম্বন করতে নাগরিকদের প্রতি অনুরোধ জানান।
এদিকে এ বছর রাজধানীতে ভয়াবহ আকার নিচ্ছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। এ মাসের ১৬ দিনেই মারা গেছে ২০ জন। অন্য বছরের চেয়ে এবার রোগীদের শারীরিক জটিলতা বেশি বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপের আশ্বাস দিয়েছেন ঢাকার দুই মেয়র।
যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা মোশাররফ হোসেন। ডেঙ্গু আক্রান্ত ছেলেকে ভর্তি করিয়েছেন মুগদা হাসপাতালে। শয্যা না থাকায় তাদের ঠাঁই হয়েছে মেঝেতে। এ হাসপাতালের বেশিরভাগ রোগীই মুগদা, যাত্রাবাড়ী, মানিকনগর বা দনিয়ার বাসিন্দা। হাতেগোনা কয়েকজন ঢাকার বাইরের। শুধু মুগদা হাসপাতালেই গত ১৫ দিনে ভর্তি হয়েছেন হাজার রোগী।
মুগদা হাসপাতাল পরিচালক ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, ‘গতবছরের চেয়ে এবার রোগীদের অবস্থা বেশি খারাপ।’
বর্ষা শুরুর আগেই ডেঙ্গুর ভয়াবহতার জন্য দুই সিটি করপোরেশনকে দুষছেন নগরবাসী।
এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে গত ১৫ জুন থেকে ৪ মাসব্যাপী ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার কার্যক্রম শুরু করেছে। আর আগামী ১৫ জুলাই থেকে ৩ মাসব্যাপী কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা রয়েছে। এডিসের লার্ভা পেলে জরিমানা করাসহ নগরবাসীর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করবে বলে জানিয়েছেন দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। তবে এসব ব্যবস্থা আগের বছরগুলোর মতোই।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনও (ডিএনসিসি) এডিস মশা দমনে জনসচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে লার্ভিসাইডে জোর দিচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে এডিসের বংশবিস্তার নিয়ন্ত্রণে, মশক নিধন কার্যক্রমে উত্তর সিটির সঙ্গে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) ও জাতীয় স্কাউট দল যুক্ত করেছে। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মশক নিধন কার্যক্রম-জনসচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করবে।
তবে নতুন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি দুই সিটি করপোরেশনকেই।
ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো, জোবায়দুর রহমান দাবি করেন, ‘আমরা আগে ফগিং ও লার্ভিসাইড এ সমান গুরুত্ব দিতাম কিন্তু এখন লার্ভিসাইড এ বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সকালে লার্ভিসাইড প্রয়োগের সময় দুই ঘণ্টা এগিয়ে ভোর ৬টায় নিয়ে আসা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা কীটতত্ত্ববিদদের এবং বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে এডিস মশা দমনে পদ্ধতিগত অনেক পরিবর্তন এনেছি। আমরা উত্তর সিটির এলাকার জন্য ১০ জনের পিআর টিম তৈরি করেছি এবং রোভার স্কাউট ও বিএনসিসির সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান করছি। পাঠ্যসূচিতে ডেঙ্গুর বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি এবং স্কুলে শিশুদের মাঝে ড্রয়িং বই বিতরণ করা হবে বিনামূল্যে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ) অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, ‘আবহাওয়ার যে ধরন সে অনুযায়ী এখন ডেঙ্গুর সংক্রমণ দ্রুত হারে বেড়ে যাবে। সঠিকভাবে এডিস মশা দমন করতে না পারলে ডেঙ্গুতে সংক্রমণ ও মৃত্যু কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে বিগত বছরগুলোর সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে।’
এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘গত ২৩ বছরে ডেঙ্গু নির্মুল তো দূরের কথা, নিয়ন্ত্রণই করতে পারিনি। এজন্য আমাদের পর্যাপ্ত কীটতত্ত্ববিদ দরকার এবং এর ওপর গবেষণা দরকার। এজন্য স্থানীয় সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২৮১ জন মারা যায়। যা দেশে এক বছরে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি রোগী মৃত্যুর রেকর্ড। এ ছাড়া ২০১৯ সালে ১৭৯ জনের মৃত্যু হয়।