নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) নিজেদের সক্ষমতা জানান দিতে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলায় একযোগে সিরিজ বোমা হামলা চালায়। মাত্র আধাঘণ্টার ব্যবধানে রাজধানীর ৩৪টি স্থানসহ ৪৫০টি স্পটে প্রায় ৫০০ বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় জেএমবি। ঝিনাইদহ জেলায় সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় জড়িত সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামিকে ১৮ বছর পর গ্রেফতার করেছে র্যাব। গ্রেফতার ব্যক্তির নাম তুহিন রেজা।
বৃহস্পতিবার (২২ জুন) দিনগত রাতে রাজধানীর তেজগাঁও রেলগেট এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি একটি বেসরকারি টেলিভিশনের ভিডিও এডিটর হিসেবে চাকরি করতেন।
র্যাব জানিয়েছে, গ্রেফতার তুহিন ২০২১ সাল থেকে তেজগাঁও এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করত। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সেখান থেকেই তাকে গ্রেফতার করা হয়। পলাতক অবস্থায় সে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে ভিডিও এডিটিংসহ বিভিন্ন সফট্ওয়্যার ভিত্তিক কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
শুক্রবার (২৩ জুন) দুপুরে কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র্যাব-৩-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারাদেশে একযোগে সিরিজ বোমা হামলা চালায় জেএমবি। দেশের ৬৩টি জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার পাশাপাশি রাজধানী ঢাকার ৩৪টি স্পটসহ সর্বমোট ৪৫০টি স্পটে প্রায় ৫০০ বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় জেএমবির জঙ্গিরা। আধাঘণ্টার ব্যবধানে চালানো এ সিরিজ বোমা হামলায় দুজন নিহত এবং দুই শতাধিক মানুষ আহত হন। একযোগে এ হামলার মাধ্যমে বাংলাদেশে নিজেদের সংঘবদ্ধ উপস্থিতির জানান দেওয়ার চেষ্টা করেছিল জেএমবি।
সিরিজ বোমা হামলায় সারাদেশের মতই ঝিনাইদহ জেলার ডিসি অফিস, জজ কোর্ট ও পায়রা বন্দরসহ কয়েকটি এলাকায় একই সময়ে একযোগে সিরিজ বোমা হামলা চালানো হয়।
দেশব্যাপী আলোড়ন ও ত্রাস সৃষ্টির ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে এ সিরিজ বোমা বিস্ফোরণের প্রকৃত রহস্য উদঘাটনসহ অপরাধীদের চিহ্নিত করার লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্রুততার সঙ্গে তদন্ত শুরু করে।
এরই ধারাবাহিকতায় এ বিস্ফোরণের ঘটনায় ঝিনাইদহ সদর থানায় অজ্ঞাতনামা জড়িতদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলাটির তদন্তে ঘটনাটি জেএমবি কর্তৃক একযোগে ঘটানোর সত্যতা প্রমাণিত হয়। ঝিনাইদহ জেলায় সংগঠিত এ বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় মোট ২১ জন জড়িত বলে আদালতে ২০০৫ সালের ২০ নভেম্বর একটি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।
মামলাটি স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল ঝিনাইদহ থেকে বিচার শেষে অভিযুক্ত ২১ জনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হলে আসামিদের সবাইকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। কিন্তু আসামিরা মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করলে আদালত তাদের অভিযোগপত্র পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে ২০০৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৪ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেন। এছাড়া ৭ আসামিকে খালাস দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদের গ্রেফতারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপরতা শুরু করে।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আরও বলেন, এরই পরিপ্রেক্ষিতে সাজাপ্রাপ্ত ১৪ জন আসামির মধ্যে ১২ জন আসামিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার করে। পলাতক দুজনের মধ্যে এ মামলার ১০ নম্বর অভিযুক্ত ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে পলাতক জেএমবি সদস্য তুহিন রেজাকে গ্রেফতার করা হয়। এ মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ৭ নম্বর অভিযুক্ত মোহন এখনো পলাতক। তাকে গ্রেফতারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রচেষ্টা চলমান।
গ্রেফতারের পর তুহিনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে র্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, ২০০৪ সালে জেএমবির ঝিনাইদহ সদর শাখায় সদস্য হিসেবে যোগদান করে তুহিন। যোগদানের পর থেকে সে এই শাখার লিফলেট তৈরি, লিখিত প্রচার-প্রচারণার সম্পাদনা, গোপন ও নাশকতমূলক খবরাখবর আদান-প্রদান, বিভিন্ন ভিডিও এডিটিংয়ের মাধ্যমে তৈরিকৃত বিভ্রান্তিমূলক প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে তরুণদের পথভ্রষ্ট করতেন। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট হামলাকে কেন্দ্র করে পূর্ববর্তী দীর্ঘ সময় ধরে তারা হামলার নীলনকশা সাজায়।
র্যাব জানিয়েছে, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট ভোর থেকেই অন্য হামলাকারীদের সঙ্গে গ্রেফতার তুহিন আদালত চত্বরের আশেপাশে অবস্থান নেন এবং হামলার সময় সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। এলোপাথাড়ি বোমা হামলার পর তারা বিভিন্ন দিকে দৌড়ে পালিয়ে যায়।
আসামি তুহিন ১৭ আগস্ট বোমা হামলার পর ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে ঝিনাইদহ সদরে জঙ্গি ক্যাম্পে কিছুদিন গা ঢাকা দেন। পরে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হলে ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে কিছুদিনের মধ্যে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে প্রথমে যাত্রাবাড়ী পরবর্তীতে খিলগাঁও, উত্তরা, মহাখালীসহ বিভিন্ন জায়গায় স্থান পরিবর্তন করে বসবাস করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার এড়াতে বিভিন্ন সময় বাসা পরিবর্তন করে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় বসবাস শুরু করেন।