সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে অবিশ্বাস্য গতিতে কমেছে বাংলাদেশিদের আমানত। মাত্র এক বছরেই সুইস ব্যাংকগুলো থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা সরিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশি নাগরিক এবং এ দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের ডলার সংকট এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। কেউ কেউ পাচার করা টাকাও হয়তো সরিয়ে নিয়েছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে ২০২২ সালে তাদের ব্যাংকগুলোর দায় ও সম্পদের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে।
প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে বাংলাদেশের পাওনা রয়েছে ৫ কোটি ৫২ লাখ সুইস ফ্রাঁ। বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ফ্রাঁ ১২০ টাকা ধরে) যার পরিমাণ মাত্র ৬৬২ কোটি টাকা। ২০২১ সাল শেষে বাংলাদেশের পাওনা ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১০ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। এর মানে এক বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা কমেছে।
মাত্র এক বছরের ব্যবধানে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা বাংলাদেশিদের অর্থ প্রায় ৮২ কোটি সুইস ফ্রাঁ বা ৯৪ শতাংশ কমে গেছে।
সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর নামে থাকা বিভিন্ন হিসাবে স্থিতির পরিমাণ ব্যাপক কমলেও ব্যক্তি গ্রাহকদের আমানত বেড়েছে। ২০২২ সাল শেষে আমানতকারীদের জমার পরিমাণ ৩ কোটি ৫৬ লাখ ৪৫ হাজার ফ্রাঁ। স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৪২৮ কোটি টাকা। আগের বছর আমানত ছিল ২ কোটি ৬৩ লাখ ৫০ হাজার ফ্রাঁ বা ৩১৬ কোটি টাকা।
সম্পদ ব্যবস্থাপকের মাধ্যমে বিভিন্ন শেয়ার বা সিকিউরিটিজে বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ বেড়েছে। গত বছর এ ধরনের বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৩৬ কোটি টাকার (৩১ লাখ ফ্রাঁ) সমপরিমাণ। আগের বছর ছিল ৬৬ হাজার ফ্রাঁ বা প্রায় ৮ কোটি টাকা। গ্রাহকের আমানত এবং বিনিয়োগের একটি অংশ পাচার হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়। সাধারণত নির্বাচনের আগে অর্থ পাচার বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদেশে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতি এখন প্রায় ৩৫০ কোটি ডলার। শুধু সুইজারল্যান্ড নয়, সারা বিশ্বেই বাংলাদেশি ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার হিসাবে (নস্ট্রো) স্থিতি কমে গেছে। কেননা বাংলাদেশ গত এক বছরের বেশি সময় ধরে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে রয়েছে। আমদানি ও ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়ে যাওয়ায় সুইস ব্যাংকগুলো থেকে বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতি অনেক কমে গেছে।
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থায় বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর হিসাবে ২০২২ সাল শেষে স্থিতির পরিমাণ মাত্র ১ কোটি ৯৩ লাখ ফ্রাঁ বা ২৩২ কোটি টাকা। আগের বছর যার পরিমাণ ছিল ৮৪ কোটি ৪৪ লাখ ফ্রাঁ বা ১০ হাজার ১৩২ কোটি টাকা।
সুইস ব্যাংকে থাকা অর্থের একটি অংশ পাচার হয়ে থাকে বলে ধারণা করা হয়। তবে পাচার সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না; এমনকি গ্রাহক আমানত হিসাবে কার কত অর্থ আছে তাও জানা যায় না। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক গোপনীয়তার স্বার্থে সব ডাটা সমন্বিতভাবে প্রকাশ করে। আলাদাভাবে কোনো গ্রাহক বা ব্যাংকের তথ্য এ প্রতিবেদনে নেই।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, প্রকাশিত পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের কাছে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে দায় এবং সম্পদ উভয়েরই তথ্য রয়েছে, যার বেশিরভাগই আমদানি ও রপ্তানির অর্থ। এর বাইরে ব্যক্তি আমানতকারীদের একটি অংশ প্রবাসী বাংলাদেশিরা। তাদের মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরি করেন। তবে একটি অংশ বাংলাদেশে থাকা গ্রাহকদেরও রয়েছে।
প্রকাশিত পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের কাছে সুইজারল্যান্ডের পাওনার তথ্যও রয়েছে, যা সে দেশের ব্যাংকগুলোর ‘সম্পদ’ হিসেবে দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশের কাছে সুইজারল্যান্ডের পাওনা ৩১ কোটি ৯০ লাখ ফ্রাঁ, যার পরিমাণ ৩ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা। ২০২১ সালে যার পরিমাণ ছিল ৫৩ কোটি ৩২ লাখ ফ্রাঁ। এসব অর্থের বেশিরভাগই বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর কাছে ওই সময়কার পাওনা।
সুইস ব্যাংকে ভারত ও পাকিস্তানের নামে থাকা অর্থও আগের বছরের চেয়ে কমেছে। ভারতের নামে রয়েছে ৩৪০ কোটি ফ্রাঁ, যা ২০২১ সালে ছিল ৩৮৩ কোটি ফ্রাঁ। অন্যদিকে পাকিস্তানের কাছে দায় ৩৯ কোটি ফ্রাঁ। আগের বছর যা ছিল ৭১ কোটি ফ্রাঁ।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বর্তমানে দেশে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দুর্বল এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা রয়েছে। অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে ইতোমধ্যে টাকার মান কমে গেছে। ফলে বিত্তবান অনেকে বিদেশি মুদ্রায় নিজের সম্পদ রক্ষা করতে চাইছেন। একদিকে অর্থনৈতিক দুর্বলতা, অন্যদিকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা– দুটি একসঙ্গে মিলিত হওয়ায় টাকা পাচার বাড়ছে।
ড. দেবপ্রিয় আরও বলেন, অর্থ পাচার রোধে দেশে কিছু ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু দেশের ভেতরে স্থিতিশীল ও দায়বদ্ধ সরকার না থাকলে এসব ব্যবস্থা কার্যকর হবে না। পাচার রোধে জবাবদিহিমূলক পরিস্থিতি এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। তথ্য-উপাত্ত ভালোভাবে সংগ্রহ করতে হবে। অর্থ পাচার নিয়ে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, দুর্নীতি দমন কমিশন, সিআইডি এবং ইমিগ্রেশনের কাছে তথ্য আছে। সেগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। এ উদ্যোগের জন্যই রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি।
বাংলাদেশের কোনো নাগরিক বা প্রতিষ্ঠান যদি নিজের বদলে অন্য দেশের নামে অর্থ গচ্ছিত রেখে থাকে, তাহলে তা সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশের নামে থাকা পরিসংখ্যানের মধ্যে আসেনি। একইভাবে সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা মূল্যবান শিল্পকর্ম, স্বর্ণ বা দুর্লভ সামগ্রীর আর্থিক মূল্যমান হিসাব করে এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অনেক দেশের নাগরিকই মূল্যবান সামগ্রী সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকের ভল্টে রেখে থাকেন।
কয়েক বছর ধরে সুইজারল্যান্ড বার্ষিক ব্যাংকিং পরিসংখ্যান প্রকাশ করছে। বাংলাদেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বা বিএফআইইউ সুইজারল্যান্ডের একই ধরনের এফআইইউর সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগও করেছিল। ব্যক্তির তালিকাসংবলিত কোনো তথ্য তারা দেয়নি। সুইজারল্যান্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, অবৈধভাবে কেউ অর্থ নিয়ে গেছে এমন প্রমাণ সরবরাহ করলে তারা তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারে।
২০১৭ সালে এ বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের বিষয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে জানান, বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ডের মধ্যে ব্যাংকের মাধ্যমে যে লেনদেন হয়, তা মূলত অর্থ পাচার নয়। তবে সামান্য অর্থ পাচার হয়।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) অর্থ পাচার নিয়ে কাজ করে। সংস্থাটি বাণিজ্যের আড়ালে কোন দেশ থেকে কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয় তার প্রাক্কলন করে। জিএফআই ২০২০ সালের মার্চে এ বিষয়ে তাদের সর্বশেষ বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। জিএফআইর প্রাক্কলন অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি ও রপ্তানির মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে বছরে গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক জোট আইসিআইজে ২০১৩ সালে বিভিন্ন দেশে কোম্পানি খুলেছে এমন ৩২ জন বাংলাদেশির নাম প্রকাশ করে। ২০১৬ সালে প্রকাশিত আইসিআইজের পানামা পেপারস ডাটাবেজে ৫৬ জন বাংলাদেশির নাম ছিল, যাঁরা করের স্বর্গ বলে পরিচিত বিভিন্ন দেশে কোম্পানির নিবন্ধন নিয়েছেন। ২০১৭ সালে প্যারাডাইস পেপারসে ২১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম পাওয়া যায়। ২০১৮ সালে একই পেপারসের সংযোজনীতে ২২ বাংলাদেশির নাম পাওয়া যায়। কর ফাঁকি দিতে, অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ গোপন করতে, কোম্পানির মুনাফা লুকাতে; পরিবারের সদস্যদের উন্নত জীবনযাপন ও আবাসনের ব্যবস্থা করতে এবং অন্যান্য কারণে অর্থ পাচার হয়ে থাকে।