তিন মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৪ দেশ সফর থেকে আরও ভালো খবরের প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এ সময় ঘনিষ্ঠ দুই মিত্র ভারত ও চীনের সরকারপ্রধানের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের সম্ভাবনা আছে।
একই সঙ্গে আমেরিকা ও রাশিয়ার সরকারপ্রধানের সঙ্গে দেখা ও কথা হতে পারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তিনি ইতালি, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত এবং আমেরিকা সফরে যাবেন জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এসব সফরকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ সরকারের নীতিনির্ধারকরা। সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারক গণমাধ্যমকে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
জুলাইয়ে ইতালির রোমে, ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অরগানাইজেশনের (ফাউ) কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হবে। এতে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীনসহ জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সরকারপ্রধানদের যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে।
আগস্টের শেষে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে রয়েছে ব্রিকস সম্মেলন। এ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যোগ দেবেন।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনেরও যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা আছে। সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভারতে জি ২০ সম্মেলন এবং এরপর তৃতীয় সপ্তাহে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র যাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রীর এ চার দেশ সফরের তথ্য নিশ্চিত করেছে গণভবন সূত্র।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান বলেছেন, একটি প্রতিবেশী দেশের স্থিতিশীলতায় আরেক প্রতিবেশী দেশ স্বস্তি অনুভব করবে-এটাই স্বাভাবিক। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার টানা ৩ মেয়াদের শাসনামলে দেশ থেকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দূর করেছে। এটাও প্রতিবেশীদের জন্য স্বস্তির বিষয়। এসব কারণে ভারত বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যাপারে ইতিবাচক হলে সেটাও স্বাভাবিক। আগামীতে দুদেশের সরকারপ্রধানের দেখা-সাক্ষাতে এসব বিষয় স্থান পেতে পারে। সেই সাক্ষাৎ থেকে ভবিষ্যতে পারষ্পরিক সুসম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করার ঘোষণা আসতে পারে।
সরকারের এক নীতিনির্ধারক বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে দুই গুরুত্বপূর্ণ শক্তির একটি হচ্ছে ভারত, অপরটি চীন। এর মধ্যে মিত্র ভারত আমাদের প্রতিবেশী। চীন আমাদের উন্নয়ন সহযোগী। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের সম্পর্কের অবনতি হলেও বাংলাদেশ প্রশ্নে বর্তমানে প্রায় অভিন্ন নীতি দেশ দুটির। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের টানা ৩ মেয়াদের শাসনামলে বিভিন্নভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে ভারত। বিনিয়োগকে কেন্দ্র করে চীনের সঙ্গেও সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে বর্তমান সরকারের।
অন্যদিকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। দেশটি প্রথমে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার প্রশ্নে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররাও বাংলাদেশ প্রসঙ্গে নানা ধরনের বিবৃতি দিচ্ছে। যা সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে চাপে সরকার দুর্বল হয়ে গেছে এমন নয়। সরকার যে ভয় পায়নি তার নজির হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে প্রকাশ্যে মন্তব্য করে তার নিন্দা জানিয়েছেন।
তারা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এসব সফরে বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা হবে। তাদের কাছে প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরার সুযোগ পাবে বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে অনেক বিষয় ফের ইতিবাচক ধারায় ফিরবে বলে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করছেন। মূলত এসব কারণেই তারা চার দেশ সফরকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের যে শীতল সম্পর্ক চলছে, তা নিয়ে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো উৎফুল্ল।
তারা মনে করছে, প্রতিবেশী ভারতের সমর্থন সত্ত্বেও বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে না। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ এবং বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার যুক্তি দেখিয়ে ভারত যদি বর্তমান সরকারের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে তাতেও কোনো লাভ হবে না-এমন মনোভাব বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের।
২১ জুন অনুষ্ঠিত জো বাইডেন ও নরেন্দ্র মোদির বৈঠকের পর দুই সরকারপ্রধানের যৌথ বিবৃতি ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উল্লেখ না থাকায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধীরা উল্লসিত বলেও মনে করা হচ্ছে।
অবশ্য যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়া, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকা ও পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক বিষয়গুলো নিয়ে দুদেশের (ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র) মধ্যে আলোচনা বেড়ে চলেছে। এতে আলোচনার গতি ও গভীরতার মাত্রা দুই-ই বৃদ্ধি পেয়েছে। দুই নেতা (ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন) আলোচনার এই ব্যাপ্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মূল্যায়ন, যৌথ বিবৃতিতে নতুন এক উদ্যোগের অবতারণা করা হয়েছে। দুদেশ জানিয়েছে, সেই উদ্যোগ ‘ইন্ডিয়ান ওশান ডায়লগ’ বা ভারত মহাসগরীয় সংলাপ। বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত যৌথভাবে চলতি বছরেই সেই আলোচনা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবে। যৌথ বিবৃতিতে বিস্তারিতভাবে এর কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।
তবে নয়াদিল্লি ও ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো মনে করছে, দক্ষিণ এশিয়ার এ আঞ্চলিক বিষয়গুলোর অন্যতম অবশ্যই বাংলাদেশ।
দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হচ্ছে, সফর শুরুর আগে ভারতের পক্ষে বিভিন্ন পর্যায়ে বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল, নতুন ভিসানীতিকে কেন্দ্র করে নির্বাচন ঘিরে যেসব প্রশ্ন উঠে আসছে এবং সেই সিদ্ধান্ত যেসব ভূ-রাজনৈতিক সম্ভাবনার জন্ম দিচ্ছে, তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কথা বলবে।
সেই আলোচনা হয়েছে কিনা, তা নির্দিষ্টভাবে জানা না গেলেও দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভারতীয় গণমাধ্যমে কর্মরত সিনিয়র সাংবাদিকরা বলছেন, বাইডেন-মোদির যৌথ বিবৃতি থেকে এটুকু বোঝা যাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক বিষয়গুলো নিয়ে দুদেশের (যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত) কথা হয়েছে।
সরকারের নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন, খুব কম সময়ের মধ্যেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। জোহানেসবার্গে ২২ আগস্ট শুরু হওয়া ব্রিকস সম্মেলনের শুরুতে অথবা সম্মেলনের পরে তাদের কথা হবে। সেখানেই বিস্তারিত আলোচনা হবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যসহ জ্বালানি সেক্টরে বিশেষ করে অর্থনীতির ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এই সংকট উত্তরণে চেষ্টা করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার। প্রতিবেশী ভারতও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
খাদ্য ও জ্বালানি উভয় ক্ষেত্রে ভারতের সহযোগিতা পেয়ে আসছে বাংলাদেশ। এই সহযোগিতার ক্ষেত্র আরও সম্প্রসারণ এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে লড়াই চালিয়ে যেতে বর্তমান সরকারের নীতির প্রতি ভারতের সমর্থন আরও বৃদ্ধি পাবে বলে তারা মনে করছেন। সেজন্য আগস্টে জোহানেসবার্গে ব্রিকস সম্মেলন কিংবা সেপ্টেম্বরে জি ২০ সম্মেলনের ফাঁকে দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ থেকে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নে বর্তমান সরকারের জন্য ইতিবাচক সংবাদ বয়ে আনতে পারে।
জুলাইয়ে ইতালির রোমে অনুষ্ঠেয় ফাউয়ের সম্মেলন পশ্চিমা দেশগুলোর সরকারপ্রধানদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে মার্কিনিদের ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তব অবস্থার একটি বিশদ ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা।
আর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বড় পরিসরে বাংলাদেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের অব্যাহত লড়াইর কথা বলবেন।
এছাড়া, মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনের নজির সম্পর্কে পশ্চিমাদের অবহিত করা ছাড়াও তাদের (রোহিঙ্গা) নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে জোরালো সমর্থন আদায় করতে পারবেন বলেও আশা করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা।