প্রথমবারের মতো হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। লাল গালিচার অপর প্রান্তে তখন অপেক্ষায় বিশ্বের ১ নম্বর ক্ষমতাধর ব্যক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। হোয়াইট হাউসে প্রবেশের পর গাড়ির দরজা নিরাপত্তাকর্মী খুলে দিলে ধীর পায়ে সৌম অবয়বে মৃদু হাসিমাখা মুখে মোদি নামলেন। লাল গালিচার অপর প্রান্ত থেকে কয়েক কদম এগিয়ে বাইডেন জড়িয়ে ধরলেন মোদিকে।
এমন দৃশ্য ভারতের ৭৫ বছরের ইতিহাসে এটাই প্রথম। বিশেষ আমন্ত্রণে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক প্রটোকল নিয়ে ২১-২২ জুন, আমেরিকায় দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফর এভাবেই শুরু করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ইতিহাসে এটাও প্রথম যে আমেরিকায় বসবাসরত কয়েক শ ভারতীয় আমেরিকানের জন্য সেদিন হোয়াইট হাউসের প্রধান ফটক খুলে দেওয়া হলো। তারা সবাই লনে দাঁড়িয়ে গেলে একটু পরেই বাইডেন-মোদি বেরিয়ে এসে দুই দেশের সম্পর্ককে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ভারতীয় আমেরিকানদের বিশাল অবদানের কথা উল্লেখপূর্বক সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
ভারতের সাবেক কূটনীতিক সৈয়দ আকবরউদ্দিন ২১ জুন দ্য প্রিন্ট অনলাইন মিডিয়ায় এক সাক্ষাৎকারে তথ্য দিলেন, এর আগে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন রাষ্ট্রপতি রাধাকৃষ্ণন ১৯৬৩ সালে জন এফ কেনেডির আমন্ত্রণে, আর দ্বিতীয়বার এই মর্যাদা পেয়েছেন ২০০৯ সালে বারাক ওবামার আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। এবার এই কাতারে তৃতীয়জন হলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বাকি সব সফরের কূটনৈতিক মর্যাদা ছিল ওয়ার্কিং সফর আর নয়তো অফিশিয়াল সফর।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে আরোপিত নিষেধাজ্ঞাকে উপেক্ষা করে রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেলের আমদানি ভারত কর্তৃক প্রায় ২০০ গুণ বৃদ্ধি, জাতিসংঘে যুদ্ধসংক্রান্ত প্রস্তাবগুলোতে ভোটদানে বিরত থেকে পরোক্ষভাবে রাশিয়ার পক্ষাবলম্বন, সেই সূত্রে ভারতের মূলস্রোতের মিডিয়ার পশ্চিমাবিরোধী অবস্থান এবং বছর দুই আগে আমেরিকার আপত্তি উপেক্ষা করে রাশিয়া থেকে অত্যাধুনিক এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা মিসাইল ক্রয় ইত্যাদি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নরেন্দ্র মোদির আলোচ্য সফরটি যে মর্যাদায় সংঘটিত হলো, তা আগে থেকে আন্দাজ করা ছিল অনেক কঠিন কাজ।
তবে সফরের প্রস্তুতিপর্বের দিকে যাঁরা নজর রেখেছেন, তাঁরা হয়তো কিছুটা হলেও অনুমান করতে পেরেছেন। জুনের প্রথম দিকে ভারতে আসেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন। এর অব্যবহিত পরে আসেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান। এতে বোঝা যায়, মোদি-বাইডেন আলোচনায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ইস্যু।
সফরের দ্বিতীয় দিনে ২২ জুন আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় কোনো রকম সহযোগী ছাড়াই দুই নেতার একান্ত বৈঠকের।
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, শীর্ষ নেতৃত্বের একান্ত বৈঠকে অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে কথা হয় এবং পরবর্তী সময়ে কর্মকর্তারা সেটি প্রতিপালন করেন, বাকি সব কিছু আনুষ্ঠিকতা মাত্র। একান্ত বৈঠকের পর দুই নেতার নেতৃত্বে দুই ঘণ্টাব্যাপী আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও প্রধানমন্ত্রী মোদি হোয়াইট হাউসের লনে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন এবং প্রশ্নের উত্তর দেন। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও গণতন্ত্র সম্পর্কিত প্রশ্নে দুই নেতাই একই সুরে উত্তর দিয়েছেন। এতে আবার বোঝা গেল আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে সব কিছুর ঊর্ধ্বে বিবেচনা পাবে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ। ভূ-রাজনীতিই সব কিছুকে ডোমিনেন্ট করবে এবং তাতে প্রথম অগ্রাধিকার পাবে নিরাপত্তার স্বার্থ। আমেরিকার প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি বিনিময়সহ জেনারেল ইলেকট্রিক অত্যাধুনিক জেট ফাইটার বিমানের ইঞ্জিন তৈরি করবে ভারতে। এই সময়ে আধুনিক প্রযুক্তির বিধাতা খ্যাত সেমিকন্ডাক্টর চিপ তৈরির জন্য ২.৭৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে ভারতে কারখানা প্রতিষ্ঠা করবে মার্কিন বিখ্যাত প্রযুক্তি কম্পানি মাইক্রন টেকনোলজি। সরকার টু সরকার ও বিজনেস টু বিজনেস কূটনীতির পাশাপাশি পাবলিক টু পাবলিক কূটনীতিতে বিশাল ভূমিকা রাখছেন প্রায় ৪০ লাখ ভারতীয় আমেরিকান, যাঁদের প্রায় সবাই সেখানকার ভোটার। ২০২৪ সালের নির্বাচনে বাইডেন আবার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হবেন। সুতরাং বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি যে একটা ফ্যাক্টর, সেটিও কিন্তু এবার বোঝা গেল। গত বছর প্রায় সাড়ে চার লাখ বিদেশি টেকনিক্যাল কোটায় আমেরিকার ভিসা পেয়েছে, যার শতকরা ৭৩ ভাগ ভারতীয়।
২২ জুন বিকেলে নরেন্দ্র মোদি কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেন। ভাষণের এক পর্যায়ে কংগ্রেসের সদস্যরা দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে অভিনন্দন জানান, যাকে কূটনৈতিক ভাষায় বলা হয় স্ট্যান্ডিং ওভেশন, বিরল সম্মান। আমেরিকার এত বছরের ইতিহাসে আর মাত্র দুজন নেতা কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে দুইবার ভাষণ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। প্রথমজন চার্চিল, দ্বিতীয়জন নেলসন ম্যান্ডেলা। এবার এই কাতারে তৃতীয়জন হলেন নরেন্দ্র মোদি।
ভারত-মার্কিন সম্পর্কের সবচেয়ে বড় দিক এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, যার মধ্যে দক্ষিণ এশিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নয়াদিল্লি থেকে সিনিয়র সাংবাদিক সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশের একটি দৈনিকে ২৪ জুন লিখেছেন, ভারত সরকার মনে করে, বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের নির্বাচনী ফলের ওপর আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির গতি-প্রকৃতি অনেকটাই নির্ভর করবে। ভারত চায় না আঞ্চলিক শান্তি, সুস্থিতি ও স্থিতিশীলতার বদল ঘটুক। অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পাক, ধর্মীয় মৌলবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি নতুন করে মাথাচাড়া দিক, ভারতের তা মোটেই কাম্য নয়। কারণ এতে ভারতের লুক ইস্ট ও অ্যাক্ট ইস্ট নীতি বিপর্যস্ত হবে। ভারতের অন্য একটি পত্রিকার সূত্রে জানা যায়, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানের সঙ্গে আলোচনায় বলেছেন, ভারত আশা করে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপে যুক্তরাষ্ট্র এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না, যাতে ভারতের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতকে আগামী দিনের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র বিচ্ছিন্নবাদিতার সব হুমকি থেকে মুক্ত থাকা সবচেয়ে বড় ও ১ নম্বর বাধ্যবাধকতা। তাই আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নীতিনির্ধারণে এই বাধ্যবাধকতার ব্যত্যয় ঘটতে পারে এমন যা কিছু হোক, তার বিরুদ্ধে যাওয়া ভারতের জন্য একান্ত অপরিহার্য। এর কোনো বিকল্প নেই। বিগত দিনের লিগ্যাসির ভয়াবহতা সবারই মনে আছে। সুতরাং দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের জাতীয় স্বার্থের যেকোনো ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায়নাকে ঘিরে তার নিজের বৃহত্তর স্বার্থেই ভারতের শঙ্কাকে প্রাধান্য দেবে, এটাই স্বাভাবিক ও যৌক্তিক ভাবনা। চেক অ্যান্ড ব্যালান্স নীতির কূটনীতিতে ভারত নিজের স্বার্থে একতরফা ও একমুখী নীতিতে যাবে না, তা কিন্তু একেবারে স্পষ্ট।
ব্রিকস (BRICS) এবং সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনে (SCO) যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ও বিপরীতমুখী রাষ্ট্রগুলোর সরব উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও দুটি সংস্থায়ই ভারত গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। এ বছরেই ব্রিকস আরো সম্প্রসারিত হবে, তা প্রায় নিশ্চিত। কিছুদিন আগে ভারতের দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন। এতে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অনেক দ্বন্দ্ব ও মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ২০২২ সালে এসে ভারত-চীনের বাণিজ্য এযাবৎকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ১২৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। মিয়ানমারে চীন-ভারত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করেছে। তাইওয়ানকে ঘিরে চীন-আমেরিকার দ্বন্দ্বে বা সবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও যদি যুদ্ধ বেধে যায়, তাহলে ভারত কোনো একটি পক্ষ বেছে নেবে এমন কোনো কথা এ পর্যন্ত শোনা যায়নি, তার কোনো ইঙ্গিতও পাওয়া যায়নি।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, যুক্তরাষ্ট্রে সফরে যাওয়ার অব্যবহিত পূর্বে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন চীনে দুই দিনের সফর করে গেছেন। বেইজিংয়ে ব্লিনকেন স্পষ্টভাবেই বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এক চীন নীতির পক্ষে, তাইওয়ানের স্বাধীনতা তারা সমর্থন করে না। এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা চললেও এই সময়ে কেউ আগ বাড়িয়ে যুদ্ধে জড়াতে চাইবে না। তবে রাজনৈতিক চাপ, কূটনৈতিক মেরুকরণ ও সামরিক শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে কে কতখানি স্পেস নিজেদের আওতায় রাখতে পারে, সেটাই এখন প্রতিদ্বন্দ্বিতার লক্ষ্য।
এই অঞ্চলের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বৈশিষ্ট্যের বর্ণনায় হেনরি কিসিঞ্জার তাঁর নিজের লেখা ‘হেনরি কিসিঞ্জার অন চায়না’ গ্রন্থের ৫২৩ পৃষ্ঠায় বলেছেন, ‘Relation between China and US need not and should not become a zero-sum game. Key issues on the international front are global in nature. Consensus may prove difficult, but confrontation on these issues is self defeating.’
যদিও এতদঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর কারো কারো সঙ্গে চীনের সমুদ্র সীমানা নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে, কয়েকটি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি আছে, তবু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক স্বার্থে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক ধরনের সমদূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছে। সিঙ্গাপুরের প্রয়াত নেতা লি কুয়ান এ প্রসঙ্গে বলেছেন,
‘Given its power, actual and potentail, China must be part of any arrangement for peace and stability and that the region’s smaller countries would have to learn to live with it. But that did not mean they could be sanguine about China’s peaceful attitude of correct non-interference in the internal affairs of other countries. America’s presence is reassuring, but even the US is on outsider with a hegemonistic record.’
(সূত্র : সুনান্দা কে দত্ত, লুকিং ইস্ট টু লুক ওয়েস্ট, পেঙ্গুইন বুকস-২০০৯, পৃ-৮১)।
সুতরাং চীন-আমেরিকার দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতায় এতদঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো নিজেদের স্বার্থে একটা ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ-ভারতও এর বাইরে নয়। ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক রক্তে গাঁথা, একেবারে অন্য রকম। দুই দেশের বন্ধন বহু রকমের গাঁটছড়ায় বাঁধা, যার প্রধান রক্ষাকবচ দুই দেশের জনগণ। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সম্পর্কটি আবার একাত্তর-বাহাত্তর পর্যায়ে পৌঁছেছে। দুই দেশের নিরাপত্তা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ, একই সূত্রে গাঁথা। ৫২ বছরের ইতিহাসে দুই দেশের সম্পর্কে ভালো-মন্দের সুখকর ও তিক্ততার উদাহরণ ও তার কারণ সবারই জানা। সুতরাং ভারত নিজের নিরাপত্তার জন্য সদা সতর্ক থাকবে, এটা নতুন কিছু নয়। আর সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় সফরটি যেভাবে হলো, তাতে বোঝা যায় ভৌগোলিক কারণেই ভারতের নিজস্ব নিরাপত্তার বিষয় যেখানে থাকবে, সে রকম সব ইস্যুতে ভারতের স্বার্থই প্রাধান্য পাবে।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
sikder52@gmail.com