উন্নত জীবনের আশায় ও উচ্চ বেতনের লোভে রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে যোগ দিচ্ছেন নেপালি নাগরিকরা। সম্প্রতি বিবিসি নেপালির এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া নেপালিদের মধ্যে একজন হলেন রামেশ (ছদ্মনাম)। উন্নত জীবনের আশায় স্টুডেন্ট ভিসায় নেপাল থেকে রাশিয়ায় গিয়েছিলেন তিনি। নেপালে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে থাকা এই তরুণ চেয়েছিলেন কোনোভাবে ওই দশা থেকে মুক্তি পেতে। পড়াশোনা শেষে হয় তিনি নেপালে ফিরে গিয়ে সাধারণ কোনো চাকরি করতেন অথবা রাশিয়ায় ভালো কোনো চাকরি খুঁজতেন। কিন্তু এসব এত সোজা ছিল না।
রমেশ জানান, আমার মতো রাশিয়ায় আসা অন্য ছাত্ররাও একই দুশ্চিন্তার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তারা ভালো কোনো চাকরি পাচ্ছে না।
রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে টিকটক ভিডিও
রমেশ ও তার মতো নেপালের আরও অনেকে যখন এমন সংশয়ের সঙ্গে লড়ছিলেন, তখন রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ শুরু করে। ইউক্রেনের ওই যুদ্ধে রুশ সেনাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন রুশ আইনে কিছু পরিবর্তন আনেন। এর মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে বিদেশিদের যোগদান সহজ ও আকর্ষণীয় হয়।
মস্কো তার সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য এক প্রকার লাল গালিচা বিছিয়ে বিদেশিদের স্বাগত জানিয়েছে। সেখানে মোটা অংকের বেতন থেকে শুরু করে রাশিয়ার নাগরিক হওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করাসহ নানা সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
রমেশ বলেছেন, তিনি রুশ সেনাবাহিনীতে যোগদানের লাভজনক প্রস্তাব গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর লিখিত পরীক্ষা ও মেডিকেল পরীক্ষার পরেই রুশ সেনাবাহিনীতে নির্বাচিত হন।
নেপালি এ তরুণ জানিয়েছেন, এই প্রক্রিয়ায় তিনি এক লাখ নেপালি রুপি ব্যয় করেছেন। তবে এই অর্থ কাকে দিয়েছিলেন, তা জানাননি।
রমেশ তার টিকটক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে রুশ সেনাবাহিনীতে যোগদানের খবর ছড়িয়ে দেন। সেখানে রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার নানা উপায়ের কথা তুলে ধরা হয়। একটি ভিডিওতে তিনি বলেছেন, এখানে অনেক চ্যালেঞ্জ। আপনি যা আশা করবেন তেমনটি হবে না। আমি মনে করি, এটি জীবনের কঠিন দিক। কারণ এই দেশটি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লড়াই করছে।
সেনাবাহিনীতে যোগদানের ‘কাউন্সেলিং সার্ভিস’
এক সপ্তাহের দীর্ঘ তদন্তে বিবিসি নেপালি দেখতে পেয়েছে, রমেশই একমাত্র নেপালি নন যিনি রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। রাজও একজন শিক্ষার্থী হিসেবে উচ্চশিক্ষার জন্য রাশিয়ায় গিয়েছিলেন। মস্কো যখন ২০২২ সালের এপ্রিলে তাদের সেনাবাহিনীতে বিদেশিদের নিয়োগ প্রক্রিয়া ঘোষণা করে, তখন তিনি নেপালিদের কাছ থেকে সাহায্যের জন্য ফোনকল পেতে শুরু করেন।
তারা মূলত চাচ্ছিলেন, রাজ যেন তাদের সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য রুশ ভাষায় ফর্ম পূরণ করতে সহায়তা করেন। কারণ তাদের রুশ ভাষা সম্পর্কে জ্ঞান কম ছিল।
রাজ বলেন, আমি কিছু নেপালিকে রুশ সেনাবাহিনীতে নাম লেখাতে আবেদনপত্র পূরণের জন্য সাহায্য করেছিলাম। বর্তমানে তারাই রুশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে ইচ্ছুকদের কাছে আমার ফোন নম্বর দিচ্ছেন।
রাজ মূলত রাশিয়ায় পড়াশোনার উদ্দেশ্যে আসতে ইচ্ছুক নেপালি শিক্ষার্থীদের পরামর্শদাতা বা কাউন্সেলর হিসেবে কাজ করতেন। এখন রুশ সেনা পদে যোগদানের জন্য সাবেক নেপালি সৈন্য ও ছাত্ররা তার কাছে সাহায্য চাইতে আসেন।
রাজের কাছে ফোন করা ব্যক্তিদের বেশিরভাগই জানতে চান, তারা কীভাবে রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারেন।
রাজ বলেছেন, নেপালিদের রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া অবৈধ কি না তা তিনি জানেন না। আর তার সেবার জন্য তিনি কোনো অর্থও নেন না।
কিন্তু তার সাহায্য নেওয়া কিছু নেপালি দাবি করেছেন, তারা প্রত্যেকে রাজকে এক লাখ করে নেপালি রুপি দিয়েছেন।
কেন রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিচ্ছেন নেপালি যুবকরা?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নেপালে ভালো সুযোগের অভাব রয়েছে। সে কারণে দেশটির তরুণরা বিদেশি সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছে।
ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী টিকারাম গৌতম বলেন, নেপালিরা পড়াশোনা বা বেড়াতে যাওয়ার অজুহাতে বিদেশে গেলেও তাদের মূল উদ্দেশ্য থাকে সেখানে গিয়ে কাজ করা ও অর্থ উপার্জন করা।
এই তরুণদের রাশিয়ার সেনাবাহিনীর প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার সম্ভাব্য কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, সেনাবাহিনীতে তারা কয়েক মাসে যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করছে, তার সমপরিমাণ আয় অন্য খাত থেকে করতে গেলে অন্তত কয়েক বছর সময় লাগতো।
নেপাল সরকারের পরিসংখ্যান বলছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৭২৯ নেপালি বিভিন্ন উদ্দেশ্যে রাশিয়ায় গেছেন।
নেপালের অভিবাসন বিভাগের তথ্যমতে, তাদের মধ্যে ৭৪৯ নেপালি শিক্ষার্থী হিসেবে রাশিয়ায় গেছেন, বাকি ৩৫৬ জন গেছেন চাকরির উদ্দেশ্যে।
রাশিয়ায় অবস্থানরত নেপালিদের বক্তব্যেও ঘুরেফিরে গৌতমের যুক্তি উঠে আসছে।
রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া এক ব্যক্তি বলেন, আমরা এখানে টাকার জন্য এসেছি। এখানে আমাদের যা অফার করা হয়, সেটা নেপালে উপার্জন করতে পারি না। আপনি অন্য দেশেও এত উপার্জন করতে পারবেন না। আপনাদের যাদের হৃদরোগের সমস্যা নেই, তারা এখানে আসতে পারেন।
আরেকজন যুবক বলেন, আমরা যদি জীবনের মায়ায় নেপালে ফিরে যাই, সেখানে কি চাকরি পাবো?
রাশিয়ায় নেপালিরা কত বেতন পাচ্ছে?
যারা ইউক্রেনে রাশিয়ার পক্ষে লড়াই করবে, তাদের আরও বেশি বেতন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে রুশ সরকার।
রাজ জানিয়েছেন, প্রশিক্ষণের সময় নেপালিদের ৬০ হাজার নেপালি রুপির সমান বেতন দেওয়া হয়।
রাশিয়ায় সামরিক প্রশিক্ষণে রয়েছেন দাবি করা আরেকজন বলেছেন, তার চুক্তিতে বলা হয়েছে, প্রশিক্ষণের সময়কাল পার হওয়ার পরে তাকে প্রতি মাসে ১ লাখ ৯৫ হাজার রুবল বেতন দেওয়া হবে।
রাজ বলেন, এই বেতনের মূল্য তিন লাখ নেপালি রুপির বেশি। এক বছরের চুক্তি শেষ হওয়ার পরে, সৈন্যরা রুশ পাসপোর্ট পাবেন এবং তারা তাদের পরিবারের সদস্যদেরও রাশিয়ায় আনতে পারবেন।
নেপাল সরকারের নিয়ম কী বলে?
ইউক্রেনে রুশ হামলার নিন্দা জানিয়েছে নেপালি সরকার এবং তারা পশ্চিমা দেশগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছে। নেপাল বলেছে, নেপালি নাগরিকদের রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার বিষয়ে কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই।
নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেওয়া লামসাল বিবিসি নেপালিকে বলেছেন, এটি আমাদের নীতির সঙ্গে যায় না।
১৯৪৭ সালে নেপালি নাগরিকদের বিদেশি সেনাবাহিনীতে নিয়োগের বিষয়ে ব্রিটেন, নেপাল এবং ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সই হয়েছিল। চুক্তিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, নেপালি নাগরিকদের ভারতীয় ও ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা হবে।
একইসঙ্গে এটিও উল্লেখ করা হয়েছে, নেপালিদের যারা তাদের সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ দেবে সেখানে তাদের ‘ভাড়াটে হিসেবে গণ্য করা হবে না’।
এর বাইরে অন্য কোনো দেশের সেনাবাহিনীতে যোগদানের ক্ষেত্রে নিজ দেশের নাগরিকদের সমর্থন করার কোনো নীতি নেপাল সরকারের নেই।
বিবিসি নেপালি এ বিষয়ে জানতে মস্কোতে কাঠমান্ডুর রাষ্ট্রদূত মিলনরাজ তুলাধারের সাথে যোগাযোগ করে। তিনি জানান, যারা রাশিয়ায় বেড়াতে বা পড়াশোনার উদ্দেশ্যে আসে, তারা অন্য নানা কাজে নিয়োজিত হতে পারেন না। নেপালের শুধু ভারত ও ব্রিটেনের সঙ্গে সেনা নিয়োগের বিষয়ে চুক্তি রয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে এ বিষয়ক কোনো চুক্তি নেই।
সূত্র: বিবিসি বাংলা