পবিত্র ঈদুল আজহা ঘিরে চামড়া সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর বার্তা দেওয়া হলেও তা কাজে আসেনি। প্রতি কোরবানির মতো এবারও চিহ্নিত সিন্ডিকেটের হাতেই ছিল চামড়ার বাজার। সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেও ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে। কিছু এলাকায় পানির দরে চমড়া বিক্রি করতে হয়েছে মৌসুমী ব্যবসায়ী ও ফড়িয়াদের।
কোরবানির ঈদে সরকার এ বছর ঢাকায় গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৬ শতাংশ বাড়িয়ে ৫০-৫৫ টাকা নির্ধারণ করেছে। রাজধানীর বাইরে গরুর কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি বর্গফুট ৪৫-৪৮ টাকা। আর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতি বর্গফুট ছাগলের চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ থেকে ২০ টাকা।
তবে সরকারের তরফ থেকে মূল্য বেঁধে দেওয়া হলেও কোরবানি পশুর চামড়ার দাম নিয়ে নৈরাজ্য তৈরি হয়েছে। রাজধানীতে ২৫ থেকে ৩০ ফুট আকারের একেকটি বড় গরুর চামড়া মাত্র ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
ঈদের দিন সকাল থেকেই শুরু হয় বৃষ্টি। এর মধ্যেই রাজধানীর সায়েন্সল্যাব মোড়ে আনা হয় পশুর চামড়া। ক্রেতা-বিক্রেতা সবার মধ্যেই দাম নিয়ে ছিল ক্ষোভ। বড় আকারের কাঁচা চামড়ার বিক্রয় মূল্য ছিল ৮০০ থেকে ৯০০ টাকার মধ্যে। আর মাঝারি গরুর চামড়া ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা এবং ছোট আকারের চামড়ার দাম দেওয়া হয় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত।
সায়েন্সল্যাব মোড়ে মৌসুমী ব্যবসায়ী সাধন চন্দ্র দাস বলেন, ৭০০ টাকা করে প্রতি পিস চামড়া কিনে নিয়ে এসে এখানে দাম দেওয়া হচ্ছে ৬০০ টাকা।
আরেক মৌসুমী ব্যবসায়ী মুকুল বলেন, বড় বড় চামড়া ৮০০ টাকার বেশি বলা হচ্ছে না। সিন্ডিকেট করে দাম কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
রাজধানীর সবচেয়ে পুরোনো চামড়ার আড়ৎ লালবাগেও পরিস্থিতির ভিন্নতা ছিল না। অভিযোগ আছে, সরকার নির্ধারিত দাম কার্যকর করেনি কোনো আড়ৎদার। বলা হয়, চামড়া প্রক্রিয়াকরণে প্রয়োজনীয় উপকরণের দাম বেশি, তাই বেশি দামে চামড়া কেনা যাচ্ছে না।
সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগরীতে সংগ্রহ করা হয় পশুর চামড়া। মাদ্রাসা ও এতিমখানার চামড়াই এখানে বেশি আসে। তবে, দামের ক্ষেত্রে ছিল হতাশা।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়শনের দাবি, কাঁচা চামড়া নিয়ে অভিযোগ থাকলেও লবণ দেওয়া চামড়া কেনা-বেচা হবে সরকার বেঁধে দেওয়া দামেই। বৃষ্টি ও বৈরি আবহাওয়ায় এ বছর পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আফতাব খান বলেন, পোস্তায় চামড়া কেনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে। বেঁধে দেওয়া দামেই বেচাকেনা হচ্ছে চামড়া।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহিন আহমেদ বলেন, মৌসুমী ব্যবসায়ীরা খুচরা পর্যায়ে বিক্ষিপ্তভাবে কেনাবেচা করছে। এতে পুরো বিক্রির ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব পড়বে না। মাদ্রাসা ও এতিমখানা থেকে যারা বিক্রি করছেন, তারা নায্য দামই পাচ্ছেন।
রংপুরে পানির দরে চামড়া
রংপুর নগরীসহ আশপাশের উপজেলায় ব্যবসায়ীরা কৌশলে ১৫-২৫ টাকা প্রতি বর্গফুটে চামড়া ক্রয় করেছেন। এভাবে চামড়া কিনেছেন রংপুরের মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তবে প্রকৃত চামড়া ব্যবসায়ীরা পুঁজি সঙ্কটে চামড়া কিনতে পারেননি। ফলে অনেকেই বাধ্য হয়ে মাদ্রাসা ও এতিমখানায় দান করেছেন কোরবানির পশুর চামড়া।
অভিযোগ রয়েছে, রংপুরে চামড়ার ১০ আড়ৎদারের সিন্ডিকেট পুরো বাজার একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের কাছে খুচরা বিক্রেতারা জিম্মি হয়ে পড়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সরকার নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী প্রতি পিস চামড়া ৮-৯শ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও আড়ৎদাররা সর্বোচ্চ ৫০০ টাকার বেশি দামে চামড়া কিনছেন না।
রংপুরের প্রধান চামড়ার আড়ৎ শাপলা চত্বর সংলগ্ন কামারপাড়া এলাকায় গরুর চামড়া নিয়ে ব্যবসায়ীরা আড়ৎগুলোর সামনে শুক্রবার রাত থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করলেও আড়ৎদাররা কেনার আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। আর কিনতে চাইলেও ফুট হিসেবে নয়, গড়ে ৪-৫শ টাকার বেশি দরে কিনতে রাজি হয়নি।
রংপুর নগরীর হাজিরাট থেকে ১০০ চামড়া নিয়ে আসা মৌসুমি ব্যবসায়ী রহমান সরকার জানান, বাণিজ্যমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, ৪৮ টাকা ফুট হিসেবে চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল সরকার। সে হিসেবে মাঝারি আকারের গরুর চামড়া সর্বনিম্ন ৭-৮শ, বড় গরুর চামড়া হাজার থেকে ১২০০ টাকা দাম হওয়ার কথা। তিনি গড়ে ৬০০ টাকা দরে চামড়া কিনেছেন। গাড়ি ভাড়া ও অন্যান্য খরচসহ সাড়ে ৬০০ টাকা পড়েছে। কিন্তু আড়ৎদাররা ৫০০ টাকার বেশি দামে চামড়া কিনতে রাজি হচ্ছে না।
একই কথা জানালেন বদরগঞ্জের মৌসুমি ব্যবসায়ী লুৎফর রহমান। জানালেন, তিনিও গড়ে ৬০০ টাকা দরে চামড়া নিয়ে আড়তে এসেছেন। আড়ৎদাররা ৫০০ টাকার বেশি দামে নিচ্ছেন না।
বিপাকে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা
দিনাজপুরের হিলিতে লাভের আশায় চামড়া কিনে বিপাকে পড়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। যে দামে চামড়া বিক্রি করতে হচ্ছে তাতে করে লাভ তো দূরের কথা কেনা দাম উঠছে না বলে দাবি তাদের।
চামড়া বিক্রি করতে আসা হিলির সাদুড়িয়া গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘এবার ৯০ হাজার টাকা দিয়ে গরু কোরবানি দিয়েছি। সেই গরুর চামড়া বিক্রি করতে এসেছি হিলিতে। কিন্তু চামড়ার যে দাম বলছে তাতে করে আমি অবাক। গ্রামেই যে চামড়ার দাম ৬০০ টাকা বলেছিল সেই চামড়া হিলিতে নিয়ে আসার পর দাম বলছে ৪০০ টাকা। গ্রামের চেয়ে এখানে আরও ২০০ টাকা কম বলছে। আবার গাড়ি ভাড়া দিয়ে এখানে আসলাম সেই খরচ তো বাদই দিলাম।’
চামড়া বিক্রি করতে আসা হিলির সাতকুড়ি গ্রামের ইয়াসিন আলী বলেন, ‘প্রতি বছরের মতো এবারও কিছুটা লাভের আশায় পাড়া মহল্লায় কোরবানির পশুর চামড়া কিনেছি। স্থানীয়দের কাছ থেকে গরুর চামড়া কিনেছি ৩৫০ টাকা করে। কিন্তু হিলিতে চামড়া বিক্রি করতে এসে শুনি দাম বলছে ৩৩০ টাকা। চামড়া কিনেছি লাভের আশায়। কিন্তু এসে দেখি বাজার খারাপ।’
চামড়া পাচারের সুযোগ নেই: বাণিজ্য সচিব
ঈদুল আজহায় পশুর চামড়ার অতিরিক্ত সরবরাহ থাকলেও দেশ থেকে অবৈধভাবে পাচার হওয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ।
গতকাল ফরিদপুরে কুরবানির চামড়ার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা এবং নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার মূল্য পরিদর্শন করার সময় সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
দেশ থেকে অবৈধভাবে চামড়া পাচার হচ্ছে কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘বিজিবি, জেলা প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। চামড়া যাতে কোনোভাবেই পাচার না সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।’
দাম প্রসঙ্গে অপর এক প্রশ্নের জবাবে সিনিয়র সচিব বলেন, ‘ঈদুল আজহার সময় চামড়ার অতি সরবরাহের কারণে দাম কিছুটা কম থাকে। কিন্তু এই চামড়া যদি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করে রাখা যায় তাহলে পরবর্তীতে ভালো দামে বিক্রয় করা সম্ভব।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে আমরা শুধু চীনের মার্কেটে চামড়া রপ্তানি করে থাকি। লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের সার্টিফিকেশন পেলে সব দেশেই রপ্তানি করা সম্ভব হবে। এতে করে চামড়ার বাজার চাঙা হবে। ব্যবসায়ীরা ভালো দাম পাবেন।