ডলার সংকটের কারণে আমদানিতে বিভিন্ন শর্ত দেওয়া হয়েছে। এর প্রভাবে বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি কিছুটা কমেছে। তবে এলসির হার কমলেও আমদানি দায় পরিশোধ খুব একটা কমেনি। একইসঙ্গে আশানুরূপ হারে বাড়েনি রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়। যার কারণে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের তুলনায় ব্যয় হচ্ছে বেশি। ফলে আর্থিক হিসাবে বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এছাড়া ঋণ পরিশোধের তুলনায় নতুন ঋণ কম আসায় সামগ্রিক বৈদেশিক লেনদেনেরও বিশাল ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
রোববার (২ জুলাই) বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্য (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) ৬ হাজার ৪৭৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এসময় রপ্তানি হয়েছে চার হাজার ৭৬০ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য। এতে করে এক হাজার ৭১৬ কোটি ২০ লাখ (১৭ দশমিক ১৬ বিলিয়ন) ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি এক ডলার ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা ধরে) এর পরিমাণ এক লাখ ৮৬ হাজার ২০৭ কোটি টাকা।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি, বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ সব ধরনের পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী ও আশানুরূপ রেমিট্যান্স ও বিদেশি বিনিয়োগ না থাকায় বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়ছে বাংলাদেশ।
বৈদেশিক লেনদেনে সামগ্রিক ঘাটতি বেড়েই চলছে
গেল অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে বাণিজ্য ঘাটতির সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এ ঘাটতি প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।
সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি বৃদ্ধি মানে বিভিন্ন উৎসে দেশে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসছে, পরিশোধ হচ্ছে তার চেয়ে বেশি। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে গেল ২০২২-২৩ অর্থবছরের সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। তার আগের অর্থবছরে বিক্রি করা হয় আরও ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার। এভাবে ডলার বিক্রির কারণে ধারাবাহিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। সবশেষ ২৫ জুন পর্যন্ত রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩০ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলারে।
চলতি হিসাবের ভারসাম্য (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স)
চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। সেই হিসাবে উন্নয়নশীল দেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকা ভালো। কিন্তু দেশে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স এখন ঋণাত্মক হয়েছে।
সবশেষ তথ্য বলছে, অর্থবছরের ১১ মাসে চলতি হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৫০ কোটি ৮০ ডলার। আগের অর্থবছরে একই সময়ে এ ঘাটতি ছিল এক হাজার ৭২৭ কোটি ডলার।
ওভারঅল ব্যালেন্স
সামগ্রিক লেনদেনেও (ওভারঅল ব্যালেন্স) বড় ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। গেল অর্থবছরের মে পর্যন্ত সামগ্রিক লেনদেনের (ঋণাত্মক) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৮০ কোটি ডলার। এ সূচকটি আগের বছর একই সময় ঘাটতি ছিল ৫৫৯ কোটি ডলার।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে এক হাজার ৯৪১ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশীরা। আগের বছর পাঠিয়েছিলেন এক হাজার ৯১৯ কোটি ডলার। প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ১৪ শতাংশ।
এফডিআই বেড়েছে ৮ দশমিক ২৭ শতাংশ
দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) সামান্য বেড়েছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে জুলাই-মে সময়ে বাংলাদেশ যেখানে ৪২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল। গেল অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়ে ৪৬২ কোটি ডলারে উঠেছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে সরাসরি মোট যে বিদেশি বিনিয়োগ আসে তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ নিয়ে যাওয়ার পর যেটা অবশিষ্ট থাকে সেটাকে নিট এফডিআই বলা হয়।
আলোচিত সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে। এ সূচকটি আগের বছরের চেয়ে ৭ দশমিক ০৩ শতাংশ কমে ১৬৩ কোটি ডলার হয়েছে। আগের অর্থবছর একই সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ১৭৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
একইসঙ্গে আলোচিত সময়ে দেশের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ (পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট) নেতিবাচক অবস্থা অব্যাহত আছে। অর্থবছরে ১১ মাসে শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ (নিট) যা এসেছিল তার চেয়ে ৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার চলে গেছে। তার আগের অর্থবছরের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল (ঋণাত্মক) ১০ কোটি ডলার।