বৃদ্ধাশ্রম! একটি শব্দ। শব্দের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে একটি স্থান, যেখানে বাস করছে শত শত বাবা-মায়ের অভিমান, বেদনা ও সন্তানদের দ্বারা বিচ্ছিন্ন হয়ে অপরিচিত চার দেওয়ালের ভেতরে বন্দি জীবনের গল্প। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে পরিবারবিহীন এক যাতনার জীবন কাটাতে কাটাতে ও মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে করতে সময় পার করা বাবা-মায়ের আশ্রয়ের নাম বৃদ্ধাশ্রম। নচিকেতার বৃদ্ধাশ্রমের গান কাকে না নাড়া দেয়!
বৃদ্ধাশ্রমের সৃষ্টি হয়েছে মূলত অসহায় বৃদ্ধ মানুষের জন্য, যাদের কোনো আশ্রয় নেই কিন্তু কালক্রমে তা রূপ নিয়েছে সভ্যতার সভ্য মানুষের অসহায় মা-বাবার শেষ আশ্রয় হিসেবে। তবে প্রশ্ন-ই উঠে, বৃদ্ধাশ্রম কোন সমাজব্যবস্থার সৃষ্টি? কোন সমাজব্যবস্থা এই বিচ্ছেদের ঘর সৃষ্টি করেছে? এর উত্তর খুঁজতে গেলে চোখ পড়ে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার প্রতি। এই সমাজব্যবস্থার মানুষের মধ্যে এক জনের প্রতি অন্য মানুষের সম্পর্ক, প্রেম, ভালোবাসা নির্ভর করে মূলত তার অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে। যে অর্থনৈতিকভাবে যত স্বাবলম্বী তাকে ঘিরে অন্যদের দরদও বেশি, আবার যে সর্বস্ব সে অপ্রয়োজনীয় বস্তুতে রূপান্তরিত হয়। শেষ বয়সে মা-বাবাদের চাকরি-বাকরি কিংবা অর্থনৈতিক সামর্থ্য না থাকার কারণে তারা হয়ে যায় পরিবারের বোঝা। তাই বৃদ্ধাশ্রমই হয়ে ওঠে একমাত্র আশ্রয়। অনেক সময় এমনো হয়, যে মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসা হয়েছে তাদের সম্পত্তির খোঁজখবর পেলে অনেক সন্তান ছুটে যায় যা মূলত ঐ বিষয়কে ফুটিয়ে তুলে যে, সন্তান এ মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বস্তুগত জিনিসের ওপর ভিত্তি করে। বৃদ্ধাশ্রম হলো মূল্যহীন মানুষের দীর্ঘ নিঃশ্বাসের দ্বারা সৃষ্ট নরকের নাম। এই সমাজব্যবস্থায় মানুষ আত্মিকভাবে মিলিত হয় না বরং তাদের মধ্যে একটা নামমাত্র বস্তুগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফলে মানুষের মধ্যে আত্মার সম্পর্কের চেয়ে প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে সম্পর্ক তৈরি হয়। যার প্রভাব সমাজ থেকে পরিবার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
আত্মিক বোধোদয়ের চেয়ে বস্তুগত ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে এই সমাজব্যবস্থা পরিচালিত হওয়ায় সৃষ্টি হচ্ছে পরিবার ভাঙন, সম্পর্কের ভাঙন। পরিবার গড়ে উঠে মূলত আত্মিক সম্পর্কের ওপর। পুঁজি যখন পরিবারের সম্পর্ক নির্ধারণ করে দেয় তখন আত্মার মিলন হওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ফলে পরিবারগুলো ক্রমান্বয়ে ধ্বংসের দিকে এগুতে থাকে। সমাজের সম্মান, অবস্থান, প্রভাব ও প্রতিপত্তি বস্তুগত জিনিসের ওপর নির্ভর করে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় মানুষ অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জনের জন্য পুরোপুরি যান্ত্রিক মানুষ হয়ে উঠে, প্রয়োজনের অধিক অর্জনের জন্য মনুষ্যত্বকে বিসর্জন দেয়। এই মনুষ্যত্ব বিসর্জনের ফলাফল এসে পড়ে পরিবারের সম্পর্কগুলোর মধ্যে। এরূপ সমাজব্যবস্থা যতটা মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে তার চেয়ে বেশি গড়ে তোলে মানবতা বিবর্জিত মানুষ হিসেবে।
বৃদ্ধাশ্রম হলো এরূপ সমাজব্যবস্থার স্থাপনা, যেখানে মূলত সমাজের চোখে মূল্যহীন বস্তুকে বন্দি করে রাখা হয়। যেহেতু প্রয়োজনীয়তার নিরিখে সম্পর্ক গড়ে ওঠে এই সমাজব্যবস্থায় তাই প্রয়োজন ফুরালেই তার মূল্য থাকে না। মানুষের আত্মিক পুনর্জাগরণই এই সমাজব্যবস্থায় সম্পর্কের সংকটের সমাধান দিতে পারে। কারণ আত্মিক বোধোদয় হলে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হবে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ যা সমাজ ও পরিবারের ভাঙন দূর করবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়