দেশজুড়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার আগে থেকেই দেখা দেয় ডেঙ্গুর প্রকোপ। আর তা বাড়তে বাড়তে এখন চরম মাত্রা ধারণ করেছে। এই বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছে ৬১ জন, যেখানে গত বছরের জুন পর্যন্ত এ রোগে মারা যান ১ জন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে মারা যাচ্ছে ৮০ শতাংশ রোগী। বাকি ১৪ শতাংশ ৪ থেকে ১০ দিনের মধ্যে এবং ৬ শতাংশ ১১ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে মারা যাচ্ছে। চলতি বছরের ২ জুলাই পর্যন্ত মৃত ৫০ জন রোগীর মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৫২১ এবং মৃত্যু ছিল ১০ জনের। সেখানে এই বছরের ৪ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৯ হাজার ৮৭১ জন। এরমধ্যে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছে ৮ হাজার ১৪১ জন।
৫৩ জেলায় ছড়িয়ে ডেঙ্গু
ডেঙ্গুতে ঢাকায় রোগীর সংখ্যা বেশি হলেও এখন ঢাকার বাইরেও রোগী বেড়েছে। গত ৩ জুলাই ২৪ ঘণ্টায় ঢাকার চেয়েও বেশি রোগী পাওয়া গেছে ঢাকার বাইরে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এ বছর এখন পর্যন্ত সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ঝালকাঠি, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, রংপুর, সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট, নাটোর, কুষ্টিয়া ও গোপালগঞ্জে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া বাকি সব জেলায় পাওয়া গেছে।
সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঢাকায়
ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে ঢাকা সবার ওপরে। এখন পর্যন্ত মোট ৬১ মৃত্যুর মধ্যে ৪৮টি ঢাকায়। এ ছাড়া চট্টগ্রামে ১১, বরিশাল ও ময়মনসিংহে ১ জন করে মারা গেছে।
নারী রোগীর মৃত্যু বেশি
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, ডেঙ্গুতে মৃত ৫০ জনের মধ্যে ৬২ শতাংশ নারী আর পুরুষ ৩৮ শতাংশ। মৃতদের ৬০ দশমিক ৮০ শতাংশের বয়স ১৯ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। এ ছাড়া ৯ শতাংশ মৃত্যু ৫০ বছরের ঊর্ধ্বে, ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের মৃত্যু ৮ দশমিক ৭০ শতাংশ, ৬ থেকে ১১ বছর বয়সীদের মৃত্যু ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং শূন্য থেকে ৫ বছর বয়সীদের মৃত্যু ৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
বেশি মৃত্যু মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, ডেঙ্গুতে মৃত ৬১ জনের মধ্যে ১৯ জনই মারা গেছে রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এরপর ৮ জন মারা গেছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৯ জন, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালে ৬ জন ও আজগর আলী হাসপাতালে মারা গেছে ৪ জন। পাশাপাশি বারডেম, কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল, ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতাল এবং স্কয়ার হাসপাতালে ২ জন করে ৮ জন মারা গেছে। অ্যাপোলো ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, শিশু হাসপাতাল, পার্কভিউ হাসপাতাল, শের-এ-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১ জন করে ৬ জন মারা গেছে।
রোগী বেড়েছে ৬ গুণ
বিগত বছর একই সময়ে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ২০২। আর এই বছর এখন পর্যন্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৮৭১ জন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের এডিসবাহী রোগ নির্ণয় কর্মসূচির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মো. ইকরামুল হক বলেন, প্রথমেই ডেঙ্গুবাহিত মশার উৎস শনাক্ত এবং ধ্বংস করা জরুরি। ডেঙ্গু কারও একার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ প্রতিটি সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণের প্রয়োজন আছে জনসচেতনতা তৈরির জন্য।
ডেঙ্গুতে বেশিরভাগ মৃত্যুর কারণ হেমোরেজিক ফিভার ও শক সিনড্রোম। এর আগে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, আমরা ক্লিনিক্যালি মৃত্যুর কারণ জানার চেষ্টা করেছি। আমাদের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত মৃতদের প্রায় প্রত্যেকে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে ভুগছিলেন এবং শক সিনড্রোমে তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া অন্য আরও কারণ থাকতে পারে, যা জানার জন্য অটোপসি করা প্রয়োজন। কিন্তু তা পরিবার অনুমোদন দেবে না। আর এটা সাধারণ প্র্যাকটিসও নয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, এবারের জরিপে লার্ভার যে ঘনত্ব উঠে এসেছে, তাতে আগামী কয়েক দিনে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবার গত কয়েক দিনের বৃষ্টির আগে করা এই জরিপের হিসাব আর বৃষ্টির পরের হিসাব এক থাকবে না। গত কয়েক দিনে থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হওয়ায় অসংখ্য পরিত্যক্ত পাত্রে পানি জমা হয়েছে, যার মধ্যে এডিস মশা ডিম পাড়বে। এই ডিমগুলো ফুটে লার্ভা, পিউপা ও উড়ন্ত মশায় পরিণত হবে। এই পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ব্যাপক হারে না বাড়ালে এ বছর ডেঙ্গু স্মরণকালের ভয়াবহ বিপর্যয় হিসেবে দেখা দেবে।