বাংলাদেশের রাজনীতির অন্ধকার যুগে প্রবেশকাল

আবদুল মান্নান

আবদুল মান্নান
আবদুল মান্নান। ফাইল ছবি

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বেশ সোচ্চার। দেশের ভেতরে যাঁরা সোচ্চার, তাঁরা সবাই বিদেশের অর্থে এই গলাবাজি করেন। আর এই মানবাধিকার নিয়ে তখনই সবাই খুব সোচ্চার হন, যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকে। আর অবাক হতে হয় যখন দেশের অন্য একটি রাজনৈতিক দল আইন করে সংবিধানে সংশোধনী এনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অধিকার আদায় করে, তখন দেশে ও দেশের বাইরে সবাই কোনো প্রতিবাদ ছাড়া তা মেনে নেয়।

৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিজ বাসভবনে তাঁর পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে সেনাবাহিনীর একদল বিপথগামী অফিসার ও সৈনিক নৃশংসভাবে হত্যা করার মধ্য দিয়ে। হত্যার এই পরিকল্পনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিফহাল ছিলেন বিএনপি নামের দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। বর্তমানে বিএনপি কয়েকটি প্যাডসর্বস্ব দল নিয়ে দেশের একটি নির্বাচিত সরকারকে উত্খাত করে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর। তাদের মতে, তারা নাকি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে।

অথচ তাদের দলের নেতা জিয়াই অনেকটা ঘোষণা দিয়ে এই দেশে গণতন্ত্র হত্যার নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট।

১৯৭৫ সালের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের দৃশ্যমান যে রাজনৈতিক ব্যক্তিটির ভূমিকা সম্পর্কে সবাই অবগত, তিনি বঙ্গবন্ধুর আজীবনের রাজনৈতিক সহকর্মী খন্দকার মোশতাক আহমদ। তবে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে মূল হাত ছিল জেনারেল জিয়ার। উচ্চাভিলাষী জিয়া ছিলেন খুবই চতুর।

অন্যের কাঁধে বন্দুক রেখে কিভাবে শিকার করতে হয়, তা তিনি ভালো জানতেন। জিয়া মানুষের কাছে এটি বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন, ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়েছেন আওয়ামী লীগের কিছু নেতা। বাস্তবে এসবের পেছনে জিয়ার উচ্চাভিলাষই প্রধান কারণ, তা এখন সবার কাছে পরিষ্কার। বঙ্গবন্ধু জিয়াকে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। খালেদা জিয়াকে তিনি তাঁর তৃতীয় কন্যার আসনে বসিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনীর উপপ্রধানের পদটি জিয়ার জন্যই সৃষ্টি করেছিলেন। জিয়াকে খুনি ফারুক-রশিদ গং বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের কথা ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসেই জানিয়েছিল। প্রজাতন্ত্রের একজন দায়িত্বশীল সেনা কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর দায়িত্ব ছিল খবরটি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানানো। তা না করে তিনি খুনিদের এই কাজে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে খুন করার পর খুনিরা প্রথমে খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদে বসায়। মোশতাক এরপর যে অপকর্মটি করেন তা হলো, বাংলাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃৃতির দ্বার উন্মুক্ত করা। বঙ্গবন্ধুকে খুন করার পর কিন্তু সংসদ বাতিল করা হয়নি। খন্দকার মোশতাক সংসদের অধিবেশন না ডেকে ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এক অধ্যাদেশ জারি করেন, যাতে বলা হয় ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুসহ যাঁদের হত্যা করা হয়েছে সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার বাংলাদেশের কোনো আদালতে করা যাবে না। এই অধ্যাদেশকে বলা হয় দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশ। তিনি পঁচাত্তরের ঘাতকদের দেশের সূর্যসন্তান হিসেবে উল্লেখ করেন। এমন ঘটনা ইতিহাসে বিরল। দেশে দেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হয়েছে; কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার করা যাবে না এমন কোনো আইন কখনো কোথাও হয়নি। যুদ্ধের ময়দানে নিয়ম-রীতি-নীতি ভঙ্গ করে যদি কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়, প্রয়োজনে অপরাধীদের বিচারের জন্য যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সেখানে বিচার করা হয়। এর ব্যতিক্রম ঘটল বাংলাদেশে। তা-ও শান্তিপূর্ণ সময়ে একটি ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার জন্য।
ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি খন্দকার মোশতাকের হাত দিয়ে করানো হলেও এটি বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এর পেছনে কালো হাতটি ছিল জিয়ার। কারণ যদিও তিনি তখন উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন, কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার আসল ক্ষমতা ছিল তাঁর হাতে। এরই মধ্যে সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহকে প্রেষণে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। পরে তাঁর জায়গায় জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান পদটি দখল করেন। ৩ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করার পর জিয়াউর রহমান খন্দকার মোশতাককে উত্খাত করে বঙ্গবন্ধুর নিয়োগ করা বাংলাদেশের প্রথম প্রধান বিচারপতি এ এস এম সায়েমকে সাক্ষীগোপাল রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদে পদায়ন করেন। একই সঙ্গে ঘোষণা করা হয়, জিয়াসহ তিন বাহিনীপ্রধান-উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করবেন।

কিছুদিন না যেতেই তিনি বিচারপতি সায়েমের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন, তিনি যেন রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। বিচারপতি এ এস এম সায়েম ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত ‘অ্যাট বঙ্গভবন : লাস্ট ফেইজ’ (বঙ্গভবনে শেষ দিনগুলো) বইয়ে সব লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, জিয়া শেষের দিকে প্রায় প্রতি রাতে আরো কিছু সেনা কর্মকর্তাকে নিয়ে বঙ্গভবনে আসতেন এবং তাঁকে পদত্যাগ করতে চাপ দিতেন। প্রথম দিকে তিনি তা করতে অস্বীকার করলেও শেষের দিকে পরিস্থিতি এমন হলো যে জিয়া বিচারপতি সায়েমের খাটে বুটসহ পা তুলে দিয়ে তাঁর কাছ থেকে জোরপূর্বক স্বাক্ষর আদায় করার চেষ্টা করতে থাকেন। একদিন তাঁকে পিস্তলের ভয় দেখালে তিনি তাঁর পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। ঘোষণা করা হয়, তিনি শারীরিক কারণে পদত্যাগ করছেন এবং তাঁর জায়গায় উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করবেন এবং দেশের প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করবেন। একই ব্যক্তির রাষ্ট্রের তিনটি পদে পদায়ন বিশ্বে নজিরবিহীন। রাত্রিকালীন কারফিউ দিয়ে জিয়া তাঁর ‘দায়িত্ব’ পালন শুরু করেন। জিয়া নিজের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার পর ১৯৭৯ সালে এক সাধারণ নির্বাচনের তামাশা অনুষ্ঠিত করেন। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে কোনো মতে ৩৯টি আসন দেওয়া হয় আর জিয়ার প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপিকে দেওয়া হয় ২০৭টি আসন।

এই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদে জিয়া সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনী বিল উত্থাপন করেন এবং সেই সংশোধনীতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের জুলাই পর্যন্ত যত অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল তার সবই ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে তা সংবিধানের অংশ করে ফেলা হয়। এই দিনটি ছিল বাংলাদেশের জন্য আরেকটি কালো অধ্যায়ের সূচনার দিন। এমন একটি কর্ম শুধু মানবতাবিরোধীই নয়, বরং সভ্যতার মুখে চরম চপেটাঘাত, আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। জিয়ার পক্ষে সবই সম্ভব ছিল। অথচ যেহেতু সংসদে বিএনপির দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল, তিনি চাইলে এই অধ্যাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত না করে তা বাতিল করতে পারতেন। ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি। তিনি বঙ্গবন্ধুর সব খুনিকে বিদেশে পালিয়ে যেতে সুযোগ করে দেন এবং বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পুরস্কার হিসেবে সব খুনিকে বিভিন্ন দূতাবাসে কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়ে পদায়ন করেন।

জিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার কিছুদিন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি রাষ্ট্রপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরও ক্ষমতা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তাঁকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ। তিনিও জিয়ার পথে হেঁটেছেন। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে হাত দেননি।

১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মুখে এরশাদের পতন হলে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসেন। তিনি সংবিধান থেকে এই আইনটি বাতিল করলে হয়তো ইতিহাস তাঁকে অন্যভাবে মূল্যায়ন করত। কিন্তু তিনি স্বামীর রেখে যাওয়া লিগ্যাসির ওপর কোনো হস্তক্ষেপ করেননি। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে এই আইন বাতিল করার জন্য একটি বিল সংসদে উত্থাপন করে এবং নভেম্বর মাসে এই মানবতাবিরোধী আইন সর্বসম্মতিক্রমে বাতিল ঘোষণা করা হয়, যার ফলে ১৯৭৫ সালের ঘাতকদের বিচারের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়। যেদিন এই আইন সংসদে বাতিল ঘোষিত হয়, সেদিন বিএনপি সংসদে অনুপস্থিত থাকে।

পঞ্চম সংশোধনীকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে বৈধতা না দিলে সেই সময়ই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করা যেত।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ওই বছরেরই ১২ নভেম্বর প্রথম ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল বিল সর্বসম্মতিক্রমে সংসদে পাস হয়। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা একটি পবিত্র ও মহান দায়িত্ব। বিচারে বিলম্ব আর বিচার না পাওয়া একই কথা। আর আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বিচার বন্ধ করে হত্যাকারীদের দায়মুক্তি দেওয়া, এমন অপরাধ তো মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। আর এই কালে আইন বিচারের সব পথ এমনভাবে রুদ্ধ করে দিয়েছিল যে ঘটনাচক্রে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা কোনো আদালতে বিচার চাইতে পারেননি। তখন কোথায় ছিল মানবাধিকারের ফেরিওয়ালারা?

২০০৫ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সামরিক আইনের মাধ্যমে জিয়ার দেশ শাসনকে বেআইনি ঘোষণা করেন। যে জিয়ার শাসনামল নিয়ে বিএনপির নিত্যদিনের বাগাড়ম্বর, সেই জিয়া আইনের বিচারে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে একজন খলনায়ক ছাড়া আর কিছুই না। তিনি চেষ্টা করেছিলেন বাংলাদেশকে একটি মিনি পাকিস্তান বানাতে। ভাগ্য তাঁর পক্ষে ছিল না। তবে তাঁর স্ত্রীও কম চেষ্টা করেননি। তিনিও ব্যর্থ হয়েছেন। হয়তো সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাও তা-ই ছিল। সেই চেষ্টায় বিএনপি আবার ফিরে এসেছে। সঙ্গে পেয়েছে কিছু ওয়ান ম্যান পার্টি। তবে বলতে হয়, হাজার হলেও এই দেশ ৩০ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ, এই দেশে গত শতকে মানবতাকে ধ্বংস করার দলটিকে তো মানুষ চিনে ফেলেছে। তাদের কর্মকাণ্ডে সমর্থন দেওয়ার অর্থ হচ্ছে মানুষের মৌলিক অধিকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া। বেঁচে থাকুক বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

শেয়ার করুন