অনিয়মের কারণে ভোট বন্ধে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা কমেনি বরং সংহত হয়েছে বলে দাবি করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তবে সংশোধিত আইনে ভোটের দিনের আগে নির্বাচন কমিশন (ইসি) চাইলে নির্বাচন বন্ধ ঘোষণা করতে পারবে কি না, তা পরিষ্কার করেননি তিনি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার একবার বলেন, এই প্রশ্নের উত্তর দেব না।’ পরে আবার বলেন, সে ধরনের পরিস্থিতি হলে কমিশন বসে সিদ্ধান্ত নেবে। আইনের বাইরে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার কমিশনের আছে, এটা ‘ইনহেরেন্ট পাওয়ার।
ভোট বন্ধে ইসির ক্ষমতা ‘খর্ব হয়েছে’ ‘নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেছে’ এমন মন্তব্যেরও কড়া সমালোচনা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। আজ সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশোধন নিয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন তিনি।
সম্প্রতি জাতীয় নির্বাচনসংক্রান্ত আইন আরপিওতে সংশোধনী আনা হয়। বিশ্লেষকেরা বলছেন, সংশোধনীতে আরপিওর ৯১ (এ) ধারায় ‘ইলেকশন’ শব্দের বদলে ‘পোলিং’ প্রতিস্থাপন করায় এখন ইসি তফসিল ঘোষণার পর ভোট শুরু হওয়ার আগে চাইলে নির্বাচন বন্ধ ঘোষণা করতে পারবে না। তবে ভোটের দিন কোনো ভোট কেন্দ্র বা পুরো আসনের ভোট বন্ধ করতে পারবে। আর রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণার পর কোনো অভিযোগ এলে যেসব কেন্দ্রের (এক বা একাধিক) বিষয়ে অভিযোগ আসবে, শুধু সেসব কেন্দ্রের ফলাফল ইসি স্থগিত করতে পারবে। পুরো আসনের ফলাফল স্থগিত করতে পারবে না।
এ বিষয় নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে একপর্যায়ে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে যান প্রধান নির্বাচন কমিশনার, ‘ইলেকশনের জায়গায় যে পোলিং এসেছে, যেহেতু আপনারা বোঝেন.. আমরা আমাদের মতো করে বুঝেছি। আপনারা যেভাবে বুঝেছেন ওভাবেই বুঝতে থাকেন। আমরা কী করতে পারবো সেটা আমরা জানি, আমরা বুঝি। এটা নিয়ে আপনারা যদি চিন্তা-ভাবনা করেন, চিন্তা-ভাবনা করতে থাকেন।’ এই বক্তব্য দিয়ে সংবাদ সম্মেলনস্থল ত্যাগ করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার।
সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেন, ১৭ জুলাই ঢাকা-১৭ নির্বাচন নিয়ে। এমন কোনো পরিস্থিতি আজ হলো যে নির্বাচন করার মতো পরিবেশ নেই, সে ক্ষেত্রে এখন যে ইলেকশন বাদ দিয়ে পোংলিং শব্দটা প্রতিস্থাপন করা হলো, এতে কমিশন আজকে চাইলে ভোট বন্ধ করে দিতে পারবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, আমি এই প্রশ্নের উত্তর দেব না। আপনি বুঝে নিজেই উত্তর দেন।
নির্বাচনের আগে কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে কমিশন ভোট বন্ধ করতে পারবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের আগের দিন ভূমিকম্প হয়ে লাখো লোক মারা গেছে, কমিশনের কিছু ইনহেরেন্ট পাওয়ার আছে, কমিশন পারবে না কেন?
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, অনিয়ম যদি হয়, নির্বাচনের আগে, আমাদের বিধান আছে, তদন্ত করতে হবে। তদন্ত করে অনিয়ম যিনি করেছেন, তাঁর প্রার্থিতা বাতিল করার সুস্পষ্ট একটা বিধান আছে। আমরা যদি দায় নিরুপণ করতে পারি যে কে অনিয়ম করেছেন, তাহলে তাঁর প্রার্থিতা বাতিল করে নির্বাচন চালিয়ে নিতে পারব। আর পোলিং বা ইলেকশন শব্দটির কারণে কোনো হেরফের হবে না। এক্সিস্টিং বিধানের কারণে প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবে।
তফসিল ঘোষণার পরদিন যদি মনে হয়, ভোটের পরিবেশ নেই, তাহলে ভোট বন্ধ করতে পারবে কি না—এমন বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, সেটা হাইপোথেটিক্যাল (অনুমাননির্ভর)। আমি রিপ্লাই করতে যাব না। ওই ধরনের পরিবেশ হতে দিন, ওইভাবে পরিবেশ হতে দেখে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।
সংশোধিত আইনে কী আছে, আপনারা কি পারবেন ভোট বন্ধ করতে? এই প্রশ্নের উত্তরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, সুযোগ নাই কেন? আইনে কোথায় নাই? যদি ওর আগের দিন বিভিন্ন কারণে একটা ইলেকশন…. । একটা বেঞ্চমার্ক থাকে যে এই এই কারণে নির্বাচন বন্ধ করতে পারবেন। এই এই কারণে বন্ধ করতে পারবেন না। যদি এমন কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, তখন অসম্ভব পরিস্থিতি কমিশনের কাছে মনে হলে কমিশন কেন পারবে না? এটা নিয়ে গবেষণাটার প্রয়োজন হলো কেন, আমি বুঝতে পারলাম না।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনার দাবি করেন, ৯১ এ-তে কোনো ক্ষমতা রহিত করা হয়নি।
তিনি আরও বলেন, আইনের বাইরে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার আছে। সেটি হলে সেটাকে বলা হয় ইনহেরেন্ট পাওয়ার। আইনে কি লেখা আছে যে নির্বাচনের আগের ভূমিকম্প হয়ে ৫০ লাখ মানুষ মারা গেলে ভোট বন্ধ করতে হবে? ওই কথা তো লেখা নেই। তারপর কি আমরা নির্বাচন করব? সেই পরিস্থিতিতে কমিশন বসে আইন-কানুন দেখে সিদ্ধান্ত নেবে। আইনটা হয়নি, এটা ছুড়ে ফেলে দেন। ভোটের আগে এ রকম পরিবেশ হলে আমরা কমিশন বসে সিদ্ধান্ত নেব।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, আমরা তিনটি জায়গায় “ইলেকশন” শব্দটাকে “পোলিং” শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছি। এটা হচ্ছে ক্লারিক্যাল কারেকশন। কারেকশন আর অ্যামেন্ডমেন্টের মধ্যে ফারাক রয়েছে। অ্যামেন্ডমেন্টের মধ্যে নীতিগত এলিমেন্ট থাকে, কারেকশনটা হচ্ছে জাস্ট সংশোধন। এটাকে নিয়ে অপব্যাখ্যা করাটা দুঃখজনক মনে করি।
তিনি বলেন, আরপিওতে ইলেকশন ও পোলিং ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এটাকে বিশাল করে দেখা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন নিজের পায়ে কুঠার মেরেছে বলা হচ্ছে। ইসির লিগ্যাল সাইড আছে। ইলেকশন শব্দটা হচ্ছে জেনাস, ইলেকশনের আন্ডারে পোলিং; পোলিংয়ের আন্ডারে ইলেকশন হয় না। ভোট গ্রহণের প্রক্রিয়াটাকে পোলিং বলা হয়। এটা ইলেকশন হবে না, পোলিং হবে।
সাংবাদিকদের উদ্দেশে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, আমাদের আপনাদের চেয়ে ভালো বোঝার কথা। আমরা সুচিন্তিতভাবে এটা কারেকশন করেছি।
তিনি বলেন, অপব্যাখ্যা দুঃখজনক। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার জন্য কাজ করব, এটা অবান্তর মন্তব্য। কমিশন ভুল করতে পারে, কিন্তু নিজের পায়ে কুড়াল মারেনি। সরকার আমাদের সম্মান করেছে। যে যে সংশোধন চেয়েছিলাম, তাতে সম্মত না–ও হতে পারত। আমরা যেসব প্রস্তাব দিয়েছিলাম, তাতে সরকারের সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। আমাদের প্রস্তাব পাস হয়েছে। জনগণ যাতে বিভ্রান্ত না হন, আমাদের অবস্থানটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
তিনি আরও বলেন, কমিশন থেকে ইসির ক্ষমতা কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, এটাও অবান্তর কথা। ক্ষমতা কমানোর প্রস্তাব পাঠাতে পারে না ইসি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার দাবি করেন, ‘৯১ (এ)-তে সংশোধন হতো, তবে আমাদের ক্ষমতার কিছু হেরফের হতো। যেহেতু ওখানে কিছু করা হয়নি, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারা, যে পোংলি পিরিয়ডে আমরা যে একটি-দুটি (ভোট কেন্দ্র) বা সব আসনের নির্বাচন আমরা বাতিল করে দিতে পারি। সেটা হুবহু আগের মতোই আছে।’
তিনি বলেন, কমিশন আরপিও সংশোধনে যে প্রস্তাব দিয়েছিল সরকার, তাতে ইসিকে সম্মান দেখানো হয়েছে। তিনি জানান, ভোট বন্ধে প্রিসাইডিং কর্মকর্তার ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। ভোটারদের বাধা দেওয়া, সংবাদকর্মী ও পর্যবেক্ষকদের কাজে বাধা দিলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য করে শাস্তির বিধান করা হয়েছে।