ডেঙ্গু মোকাবিলায় সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত

সম্পাদকীয়

ডেঙ্গু
ফাইল ছবি

সারাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি যে ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে– তাতে কোনো সন্দেহ নেই। চলতি বছরের সর্বশেষ পরিসংখ্যানমতে, দেশের ৫৭টি জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে গেছে। ইতোমধ্যে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৬৭ জনের এবং আক্রান্ত হয়েছেন ১২ হাজার। এর মধ্যে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন প্রায় আড়াই হাজার ডেঙ্গু রোগী। আর চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন ৯ হাজারের অধিক। শুধু গত মাসেই মৃত্যু হয়েছে ৩৪ জন ডেঙ্গু রোগীর। অথচ ২০২১ সালে দেশে এই সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১০০ এবং মৃত্যু ছিল শূন্যের কোটায়।

দেশে যত ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে তার মধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি। সারাদেশের ডেঙ্গু আক্রান্তের ৬০ ভাগই ঢাকায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা হাসপাতাল ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। গত কয়েক বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ২০১৯ সালে। জানা গেছে, চলতি বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি ২০১৯ সালের চেয়েও খারাপ হতে পারে। এবার ডেঙ্গুর মৌসুম গত বছরের মতোই দীর্ঘ হতে পারে। কাজেই কর্তৃপক্ষ এখনই যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। এ বিষয়ে আমাদের বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতা মোটেও ভালো নয়। আমরা আশা করব, পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করার পূর্বেই কর্তৃপক্ষ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। এক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সুফল পেতে হলে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রমের পাশাপাশি নগরবাসীকেও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।

universel cardiac hospital

প্রকৃতপক্ষে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের কাজটি অত্যন্ত জটিল। বহুতল ভবনের প্রতি তলায় সিটি করপোরেশনের কর্মীদের প্রবেশের কাজটি কতটা কঠিন তা সহজেই অনুমেয়। কাজেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নগরবাসীকে সম্পৃক্ত করার বিষয়ে গুরুত্ব বাড়াতে হবে এবং এই দায়িত্বটি সিটি করপোরেশনকেই পালন করতে হবে। বছরব্যাপী মশক নিধন কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। দুঃখজনক হলেও একথা সত্য যে, মশা নিয়ন্ত্রণে প্রতিবছর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করলেও সে অনুযায়ী সেবা মিলছে না। যেহেতু ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো প্রতিষেধক বা টিকা নেই, তাই সুরক্ষিত থাকার একমাত্র উপায় হলো মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করা। এজন্য প্রথমেই রোধ করতে হবে এডিস মশার প্রজনন ও বংশবিস্তার। কোথাও যাতে পানি জমে থাকতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব হলো নগরীর সর্বত্র, বিশেষ করে যেসব স্থানে মশার বংশবিস্তারের অনুকূল পরিবেশ রয়েছে, সেসব স্থানে মশা নিধনের কার্যক্রম পরিচালনা করা। থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হলে এডিস মশার বংশবিস্তারের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এমন পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, চলতি বর্ষা মৌসুমে সামনের দিনগুলোতে ডেঙ্গু আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। সাধারণত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এ সময় সবাইকে বিশেষ সচেতনতার পরিচয় দিতে হবে; বাসাবাড়ি পরিষ্কার রাখতে হবে। এডিস মশা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই রাজধানীসহ সর্বত্র মশা নিধনে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে।

সারা দেশে মশক নিধন কার্যক্রমে কেন কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসছে না, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আমাদের স্মরণ রাখা উচিত, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসমূহের উদাসীনতার কারণেই ২০১৯ সালে রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গু মহামারি আকার ধারণ করেছিল। সরকারি হিসাবেই ঐ বছর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা এক লক্ষ ছাড়িয়ে ছিল; আর মৃত্যু হয়েছিল ১৭৯ জনের। এবারও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। বস্তুত আমাদের দেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধে বছরজুড়ে কোনো তদারকিই থাকে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ইনডেক্স ঘোষণা এবং আগাম সতর্কতা জারি করে তাদের দায়িত্ব শেষ করে। পরে রোগী ব্যবস্থাপনা নিয়ে বক্তব্য-বিবৃতি প্রদান করে। অপরদিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বা সিটি করপোরেশন আগাম সতর্কতা পাওয়ার পরও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ না নিয়ে অপেক্ষা করে। যখন ডেঙ্গু ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তখন লোকদেখানো ওষুধ ছিটানো শুরু হয়। কাজেই আমরা মনে করি, ডেঙ্গু মহামারি আকার ধারণের পূর্বেই কোনো প্রকার সময়ক্ষেপণ না করে ডেঙ্গু মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে সিটি করপোরেশন ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহকে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।

শেয়ার করুন