সড়কে অপ্রত্যাশিত দূর্ঘটনায় প্রতিদিন ঝড়ছে বহু মূল্যবান প্রাণ। সম্প্রতি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার স্বাক্ষরিত সড়ক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনেও এই চিত্রটিই ফুটে উঠেছে। প্রতিবেদনটিতে দেখা যায়, গত জুন মাসে সারাদেশের সড়কে ৫৬২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৫০৪ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। একইসঙ্গে আহত হয়েছেন ৭৮৫ জন।
এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১৩৮টি দুর্ঘটনায় ১০৩ জন নিহত এবং ২০৬ জন আহত হয়েছেন। চট্টগ্রাম বিভাগে ৯৮টি দুর্ঘটনায় ৯২ জন নিহত এবং ১২৫ জন আহত হয়েছেন; রাজশাহী বিভাগে ১০১টি দুর্ঘটনায় ৯৮ জন নিহত এবং ১১৫ জন আহত হয়েছেন; খুলনা বিভাগে ৫৯টি দুর্ঘটনায় ৪৮ জন নিহত এবং ৯০ জন আহত হয়েছেন; বরিশাল বিভাগে ২৪টি দুর্ঘটনায় ১৭ জন নিহত এবং ৭৯ জন আহত হয়েছেন; সিলেট বিভাগে ৩৬টি দুর্ঘটনায় ৪২ জন নিহত এবং ৭৬ জন আহত হয়েছেন; রংপুর বিভাগে ৫৭টি দুর্ঘটনায় ৫৮ জন নিহত এবং ৪৪ জন আহত হয়েছেন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৪৯টি দুর্ঘটনায় ৪৬ জন নিহত এবং ৫০ জন আহত হয়েছেন।
জুন মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় সংগঠিত মোটরযানের মধ্যে মোটরকার ৩১টি, বাস ১০২টি, পিকআপ ৫৪টি, অটোরিকশা ৫০টি, ট্রাক ১৯২টি, মোটরসাইকেল ১৯৬টি, ব্যাটারিচালিত রিকশা ৫৭টি, ইজিবাইক ২৩টি, ট্রাক্টর ৬টি, অ্যাম্বুলেন্স ৩টি, ভ্যান ২১টি, মাইক্রোবাস ১৬টি ও অন্যান্য যান ৯৯টিসহ সর্বমোট ৮৫০টি। এর মধ্যে মোটরকার দুর্ঘটনায় ৬ জন, বাস দুর্ঘটনায় ৩২ জন, পিকআপ দুর্ঘটনায় ৪১ জন, অটোরিকশা দুর্ঘটনায় ৪০ জন, ট্রাক দুর্ঘটনায় ৬০ জন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৬৫ জন, ব্যাটারিচালিত রিকশা দুর্ঘটনায় ৫৬ জন, ইজিবাইক দুর্ঘটনায় ২৩ জন, ট্রাক্টর দুর্ঘটনায় ৪ জন, অ্যাম্বুলেন্স দুর্ঘটনায় ৯ জন, ভ্যান দুর্ঘটনায় ৬ জন, মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় ৭ জন ও অন্যান্য যান দুর্ঘটনায় ৫৫ জনসহ সর্বমোট ৫০৪ জন নিহত হয়। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
এসব অনাকাঙ্খিত মৃত্যুর পেছনে প্রধান ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করে ফিটনেসবিহীন গাড়ি। সড়কে প্রতিদিন অনেক ফিটনেসবিহীন গাড়ি চোখে পড়ে। এমনকি ফিটনেস না থাকলেও অনেক গাড়ি ফিটনেস সার্টিফিকেট পেয়ে যায়। চোখের দেখাতেই দিয়ে দেয়া হয় ফিটনেস সার্টিফিকেট। চালকরা ঘরে বসেই পেয়ে যান ড্রাইভিং লাইসেন্স। সড়কে প্রচণ্ড প্রতাপে লক্করঝক্কর গাড়ি চললেও কর্তৃপক্ষ দেখেও না দেখার ভান করে। সম্প্রতি আদালতে উপস্থাপন করা বিআরটিএ’র একটি প্রতিবেদনের তথ্য থেকে জানা যায়, ফিটনেস নবায়ন ও এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়াই দেশে ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৩২০টি গাড়ি চলাচল করছে। প্রকৃতপক্ষে ফিটনেসবিহীন, মেয়াদোত্তীর্ণ ও লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ির সংখ্যা এর বেশি ছাড়া কম হবে না। অথচ গত মাস পর্যন্ত তাদের কাগজপত্র নবায়ন করা হয়নি। এমন পরিস্থিতি রাষ্ট্রের জন্য সত্যিই উদ্বেগজনক। তবে আশার বাণী হচ্ছে, এসব গাড়ির ফিটনেস নবায়ন করে দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছেন হাইকোর্ট। এ সময়সীমার মধ্যে নবায়নে ব্যর্থদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বিপুলসংখ্যক গাড়ি ফিটনেসবিহীন চলাচলের পরও বিআরটিএ, ট্রাফিক পুলিশ, পুলিশ প্রশাসন, সর্বোপরি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এতদিন কেন দৃশ্যমান ও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি? আদালতকে এতগুলো ফিটনেসবিহীন গাড়ির তথ্য জানতে হয়েছে স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করে।
পরিবহন খাত হলো দেশের সবচেয়ে বিশৃঙ্খল খাত। এখানে শৃঙ্খলা ও নিয়মনীতির বালাই তো নেই-ই, উল্টো ইচ্ছামতো ভাড়া আদায়, যাত্রীদের হয়রানি ও জিম্মি করা, গাড়ি থেকে ফেলে দিয়ে হতাহত করা, গাড়িতে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি করা, এমনকি আদালতের আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো নৈমিত্তিক বিষয়। আর এসব অনিয়ম করা হয় অনেক ক্ষেত্রে ফিটনেস ও যথাযথ কাগজপত্রবিহীন গাড়ি নিয়ে! কোথাও ফিটনেসবিহীন গাড়ি আটক করে তার লাইসেন্স বা রোড পারমিট বাতিল করা হয়েছে, মালিকের কাছ থেকে জরিমানা আদায় বা তাকে শাস্তি দেয়া হয়েছে কিংবা গাড়ি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে- আজ পর্যন্ত এমন নজির দেখা যায়নি। এমনকি কোনো সড়ক দুর্ঘটনার ন্যায়বিচার হয়েছে- এমন দৃষ্টান্তও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিকট শব্দ ও কালো ধোঁয়া পরিবেশ দূষিত করে। ফলে মানুষের নানা অসুখ-বিসুখ হয়। তাছাড়া এসব লক্কড়ঝক্কড় গাড়িতে যেতে যাত্রীদের চরম ভোগান্তি হয়। অনেকেই গাড়ির হেল্পার থেকে চালক হয়ে থাকেন, যাদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই। লেখাপড়াও নেই তেমন। অনেকেই অশিক্ষিত। কোনোরকমে নামদস্তখত করতে পারে। অথচ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তাদের হাতেও চলে আসে অরিজিনাল লাইসেন্স! অনেকে ভুয়া লাইসেন্স দিয়েই গাড়ি চালায়। গাড়ি চালানোর সময় অধিকাংশ চালককে মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। অনেকে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালায় এবং আগে যাওয়ার জন্য পাল্লা দেয়, যার কারণে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। চালক শিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হলে এমনটি হওয়ার প্রবণতা যে অনেক হ্রাস পেতো, বুঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
এমতাবস্থায় আমরা মনে করি, ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়া জরুরি। শুধু কাগজপত্র আপডেট করলেই ফিটনেসবিহীন গাড়ি ফিট হয়ে যায় না। গাড়ির ইঞ্জিন, চেসিস, সিট, বাম্পার, ব্রেক, লাইট, বডিসহ সবকিছু বিজ্ঞানসম্মতভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হবে। চোখের দেখা, নামমাত্র চেকিং পরিত্যাগ করতে হবে। গাড়ি ও চালকের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আসল, না নকল তা সঠিকভাবে নির্ণয় করতে হবে। নকল ধরা পড়লে আইনি প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৯০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহনের অতিরিক্ত গতি ও চালকের বেপরোয়া মনোভাব। মহাসড়কে অপরিকল্পিত স্পিডব্রেকার বা গতিরোধকগুলোও দুর্ঘটনার জন্য অনেকাংশে দায়ী। এতদ্ব্যতীত ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, সড়কের পাশে হাটবাজার বসা, চালকদের পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাব ইত্যাদি কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে। মহাসড়কে যান চলাচলের সর্বোচ্চ গতি বেঁধে দিয়ে এবং গতি পরিমাপক যন্ত্র ব্যবহার করে চালকদের ওই নির্দিষ্ট গতি মেনে চলতে বাধ্য করা হলে দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আইনের প্রয়োগ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ চালক এবং সড়কে চলাচল উপযোগী ভালো মানের যানবাহন অবশ্যই প্রয়োজন। পাশাপাশি জনসাধারণকেও হতে হবে সচেতন।
সবশেষে বলতে চাই, সড়কে জনদুর্ভোগ, হয়রানি ও দুর্ঘটনা রোধের বিষয়গুলোতে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। জনস্বার্থে সরকার ও কর্তৃপক্ষ কার্যকর ব্যবস্থা নেবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।