রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের জেরে স্বাক্ষরিত কৃষ্ণসাগরীয় শস্য চুক্তির মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। প্রায় এক বছর আগে স্বাক্ষরিত এই চুক্তির মেয়াদ বেশ কয়েক দফায় বাড়ানো হয়েছে এবং আজ সোমবার শেষ হতে চলেছে এটির মেয়াদ।
রাশিয়া এখনও এই চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে রাজি না হওয়ায় এর ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। আর এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেন ছেড়ে গেছে শস্যবাহী শেষ জাহাজটি। সোমবার (১৭ জুলাই) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোমবার শেষ হতে চলেছে কৃষ্ণসাগর চুক্তির সময়সীমা। ইতোমধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে শস্য চুক্তির অধীনে ইউক্রেনের ওডেসা বন্দর ছেড়ে গেছে শস্যবাহী সর্বশেষ জাহাজটি।
ডেটা সাইট মেরিনট্র্যাফিক বলছে, মেয়াদ শেষ হওয়ার একদিন আগে স্থানীয় সময় রোববার সকালে শস্য নিয়ে বন্দর ছেড়ে যায় জাহাজটি। বার্তাসংস্থা রয়টার্সও এই তথ্য নিশ্চিত করে বলেছে, টিকিউ স্যামসান নামের শস্যবাহী জাহাজটি রোববার ইউক্রেনের বন্দর ছেড়েছে।
বিবিসি বলছে, রাশিয়া তার নিজস্ব শস্য ও সারের চাহিদা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত জাতিসংঘের মধ্যস্ততায় স্বাক্ষরিত এই চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে রাজি হয়নি। মূলত ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রায় আগ্রাসনের পর বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের আশঙ্কার মধ্যে ২০২২ সালের জুলাই মাসে চুক্তিটি করা হয়েছিল।
বিশ্বের শীর্ষ শস্য রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে ইউক্রেন এবং রাশিয়া উভয়ই রয়েছে।
মেরিন ট্র্যাফিক বলেছে, তুরস্কের পতাকাবাহী ওই জাহাজটি স্থানীয় সময় রোববার সকাল ৮টার পরপরই ইউক্রেনের ওডেসা বন্দর ছেড়ে তুরস্কের শহর ইস্তাম্বুলের দিকে যাত্রা করে। ইউক্রেন অবশ্য এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেনি।
এর আগে গত শনিবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জানান, মস্কোর নিজস্ব খাদ্য রপ্তানি এবং অন্যান্য প্রধান কিছু বিষয়ের প্রতিবন্ধকতা দূর করার প্রতিশ্রুতি পূরণ করা হয়নি। তার এই মন্তব্য এই ইঙ্গিত দেয় যে, শস্য চুক্তিতে মস্কো তার অংশগ্রহণ স্থগিত করতে পারে।
এছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার সাথে ফোন কলে পুতিন বলেন, ‘এই চুক্তির মূল লক্ষ্য আফ্রিকা মহাদেশসহ প্রয়োজনীয় অন্য দেশগুলোতে শস্য সরবরাহ করা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।’
এর আগে গত জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে মস্কো আর এই শস্য চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে রাজি নয় বলে জানিয়েছিলেন ক্রেমলিনের মুখপাত্র ও প্রেস সেক্রেটারি দিমিত্রি পেসকভ।
রুশ দৈনিক ইজভেস্তিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেসময় পেসকভ বলেন, ‘এই চুক্তির পেছনে আমাদের কিছু শর্ত ছিল। দুঃখজনক হলেও সত্য— সেসবের কোনোটিই মানা হয়নি। ভবিষ্যতে কী হবে— তা এখন বলা খুবই কঠিন; তবে আমরা বলতে পারি— মস্কো আর এই চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে আগ্রহী নয়। আমরা অনেক ভদ্রতা দেখিয়েছি, অনেক ছাড় দিয়েছি… কিন্তু আর নয়।’
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রুশ সেনারা হামলা করার পর দেশটির ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুইফট ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। রাশিয়া চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য এখন শর্ত জুড়ে দিয়েছে, তাদের কৃষি ব্যাংক রোসেলখোজব্যাংককে সুইফটের সঙ্গে পুনঃসংযোগ করতে হবে।
তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক কর্মকর্তা জানিয়েছে, রুশদের এ দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছেন না তারা। অবশ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন রোসেলখোজব্যাংককের সহায়ক প্রতিষ্ঠানকে সুইফটে যুক্ত করার কথা ভাবছে।
রাশিয়া গত বছর ইউক্রেনে সেনা পাঠিয়ে দেশটির কৃষ্ণসাগরের জাহাজ চলাচল পথ ও বন্দরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়। এতে করে ইউক্রেনের উৎপাদিত শস্য বন্দরে আটকে যায়। মূলত কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার অবরোধের কারণে ইউক্রেনের বন্দরে রপ্তানির জন্য প্রস্তুত থাকা কোটি কোটি টন খাদ্যশস্য আটকা পড়ে ছিল।
এতে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম দ্রুত হারে বাড়তে থাকে যার ফলে দরিদ্র দেশগুলোয় খাদ্য সঙ্কট দেখা দেয়। এমন পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের বন্দরগুলো দিয়ে খাদ্যশস্য রপ্তানি স্বাভাবিক করতে গত বছরের ২২ জুলাই রাশিয়া–ইউক্রেনের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। যা কার্যকর হয় আগস্ট মাসের শুরু থেকে।
চুক্তির মধ্যস্থতায় ছিল জাতিসংঘ ও তুরস্ক। ওই চুক্তির ফলে রাশিয়া কৃষ্ণসাগরে তাদের অবরোধ শিথিল করে যাতে ইউক্রেন থেকে সমুদ্রপথের নিরাপদ করিডর দিয়ে খাদ্যবাহী জাহাজ চলাচল করতে পারে। এতে করে আগস্ট থেকেই ইউক্রেনের তিনটি বন্দর থেকে বাকি বিশ্বে নিরাপদে খাদ্যশস্য রপ্তানির পথ খুলে যায়।
গত বছরের ১৭ নভেম্বর চুক্তিটি নবায়ন করা হয়। ওই সময় চুক্তির মেয়াদ ১২০ দিন বাড়ানো হয়েছিল। যা শেষ হওয়ার কথা ছিল ১৮ মার্চ। তবে সেসময় চুক্তির মেয়াদ ১২০ দিন বাড়ানোর কথা থাকলেও রাশিয়া মাত্র ৬০ দিন বাড়াতে সম্মত হয়।
চুক্তির অধীনে গত প্রায় এক বছরে কৃষ্ণসাগর দিয়ে ৩০ মিলিয়ন টনেরও বেশি শস্য এবং অন্যান্য খাবার ইউক্রেন ছেড়ে গেছে। জাতিসংঘ বলেছে, এই চুক্তির অধীনে ইউক্রেনের ৪৭ শতাংশ শস্য স্পেন ও ইতালিসহ ‘উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে’ গেছে।
তুরস্ক ও চীনের মতো ‘উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে’ গেছে ২৬ শতাংশ এবং মিশর ও সুদানের মতো ‘নিম্ন এবং নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে’ গেছে ২৭ শতাংশ।
প্রেসিডেন্ট পুতিন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বেশি শস্য রপ্তানি না করার জন্য ইউক্রেনের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু জাতিসংঘ বলেছে, শস্য চুক্তি সারা বিশ্বে মানুষের উপকার করেছে কারণ এটি বিশ্ববাজারে আরও খাদ্য পণ্য এনেছে এবং বিশ্বব্যাপী দামও কমিয়েছে।