বিএনপির প্রধানমন্ত্রী-মুখ কে?

মনোয়ার রুবেল

বিএনপি
ফাইল ছবি

ভারতের কংগ্রেসের মুখপাত্র অখিলেশ প্রতাপ সিং চার সপ্তাহ আগে ঘোষণা করেছেন– কংগ্রেসের এবারের প্রধানমন্ত্রী-মুখ রাহুল গান্ধী। তাঁকে সামনে রেখে কংগ্রেস আগামী লোকসভা নির্বাচনে প্রচারণা চালাবে। এর মধ্য দিয়ে বিগত কয়েকটি নির্বাচনের রণনীতি থেকে দলটি কার্যত সরে এলো। ব্যাক-টু-ব্যাক পরাজয়ের পর কংগ্রেস মনে করছে, তাদের একজন প্রধানমন্ত্রী-মুখ থাকাই বরং ভালো হবে।

২০১৯ সালে কংগ্রেসকে বারবার প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে– নির্বাচিত হলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন? নরেন্দ্র মোদির দোর্দণ্ড ব্যক্তিত্বের সঙ্গে লড়ার মতো একটি চেহারা কংগ্রেস ভোটাররা খুঁজেছিল। সে মুখ আড়ালে রেখে কংগ্রেস খুব সুবিধা করতে পারেনি। কারণ, ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রনেতার ব্যক্তিগুণ বিচার করে ভোট দিতে মানুষ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বলা বাহুল্য, ওই নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবি ঘটে। 

universel cardiac hospital

বাংলাদেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বিএনপির কোনো প্রধানমন্ত্রী-মুখ ছিল না। কখনও কোথাও কেউ তারেক রহমানকে ব্র্যান্ডিং করেছেন, কখনও খালেদা জিয়াকে সামনে রেখে প্রচার চালিয়েছেন। বাহ্যত বিএনপি তার ভবিষ্যৎ সরকারপ্রধান নির্ধারণ করে তাঁর মুখখানি জনমনে এঁকে দিতে পারেনি। এই ব্যর্থতা খুব বেশি প্রকাশ্য আলোচনায় আসেওনি। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী-মুখ থাকলেও বিএনপি খুব বেশি লাভবান হতো কিনা, তাও অজানা। তবে আওয়ামী লীগের দিক থেকে বারবার প্রশ্ন তোলা হয়েছে– কে বিএনপির প্রধানমন্ত্রী হবেন।

সত্যি বলতে কি, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরেও বিএনপির কোনো প্রধানমন্ত্রী-মুখ নেই। কোনো এক সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঠিক এমন প্রশ্নের জবাবে গত বছরে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, খালেদা জিয়াই হবেন প্রধানমন্ত্রী; না হয় তারেক রহমান।

প্রকৃত সত্য হলো, দুটো অপশনের কোনোজনই বোধহয় বিএনপির নিকট-ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। শারীরিক অসুস্থতা ও আইনি জটিলতায় খালেদা জিয়ার গতবারের মতো এবারও নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ কম। তারেক রহমান নির্বাচনে অংশ নেবেন– সেই সুযোগও এখন পর্যন্ত আইনিভাবে সীমিত। আর সংসদ সদস্য না হলে কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন না। সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদে বলা হচ্ছে– ‘(৩) যে সংসদ-সদস্য, সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন বলিয়া রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হইবেন, রাষ্ট্রপতি তাঁহাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করিবেন।’

আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি জিতে গেলেও তাৎক্ষণিক তারেক রহমানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সংসদ গঠিত হলে বিএনপিকে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান ছাড়া তৃতীয় একজনকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করতে হবে, যিনি তারেক রহমানের জন্য কয়েক মাস বাদে পদ ছাড়তে সম্মত হবেন। কোনো একটি আসনে উপনির্বাচনে তারেক রহমান জিতে এলে তারপর প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করলে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি নিযুক্ত হতেও পারেন। এত ‘যদি’র মাঝে আরেকটা ‘যদি’ রয়েছে। তা হলো, তারেক রহমানকে উপনির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে আইনি বাধামুক্ত থাকতে হবে। তিনি আইনে সাজাপ্রাপ্ত ও বর্তমানে ফেরারি হিসেবে চিহ্নিত। বিএনপি ক্ষমতার স্বাদ পেলেও তিনি কত দ্রুত আইনি মুক্তি পাবেন– তা নিয়ে সন্দিহান হওয়ার অবকাশ রয়েছে।

তারেক রহমানের দল যদি আগামী নির্বাচনে জয়লাভ করে, তিনি সংগত কারণেই চাইবেন যত দ্রুতসময়ে সম্ভব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অধিষ্ঠিত থাকতে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে সাংবিধানিক বা আইনি বাধা দূর করার আগে নতুন কারও হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে পলিটিক্যাল ক্যু-এর মধ্যে পড়ার ভয়ও আছে। তারেক রহমানের আস্থাহীনতার অস্থিরতা বদরুদ্দোজা চৌধুরীর রাষ্ট্রপতিত্বকালে দেখা গেছে। দলের প্রবীণ ও প্রভাবশালী এই নেতাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই ২০০২ সালে ‘অপসারণ’ করা হয়েছিল স্রেফ আনুগত্যহীনতার অভিযোগে।

রাজনৈতিক অন্য অনেক ব্যর্থতা নিয়ে বিএনপির সমালোচনা করা যায়। আগামী নির্বাচনে বিএনপির তরফে প্রধানমন্ত্রী-মুখ কে হবেন, তা নির্ধারণ করে জনসমক্ষে তুলে না ধরতে পারা সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক কৌশলগত ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার শেলে জর্জরিত হতে হবে ভোটের ময়দানে।

এই মুহূর্তে বিএনপিতে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরই সবার পছন্দনীয়। তিনি বিগত সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েও জনগণের মতামতকে কোরবানি দিয়ে দলের নেতৃত্বের প্রতি ‘একান্ত বাধ্যগত’ থেকেছেন। তবু বলা হচ্ছে, সংসদ সদস্য পদ ও সরকারপ্রধান একই বিষয় নয়। কেউ একই স্যাক্রিফাইস দ্বিতীয়বার নাও করতে পারেন।

ঘটনা যাই হোক, যিনিই প্রধানমন্ত্রী-মুখ হোন না কেন; বিএনপি এখন পর্যন্ত তা নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপির যেসব শুভাকাঙ্ক্ষী বর্তমান রাজনৈতিক সময়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে অতীব আশাবাদী, তারা নিশ্চয় তাদের ‘পোস্টারবয়’ খুঁজে বের করবেন। আপাত তেমন কেউ নেই।

প্রশ্ন হতে পারে, প্রধানমন্ত্রী-মুখ থাকাটা কি জরুরি? বাংলাদেশের মতো অনুন্নত গণতন্ত্রের দেশে একটি চেহারা ইশতেহারের কাজ করে। আস্থা, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার কাজ করে। লিখিত কয়েক পাতার অঙ্গীকারে যে আস্থা থাকে না; নেতার চোখে তাকিয়ে গহিনে তার চেয়ে শতগুণ আস্থা ফিরে পান ভোটার। নেতার নাম থাকতে হয়, ছবি থাকতে হয়। এই দেশের রাজনীতিতে বিশ্বাস বিমূর্ত, কিন্তু নেতা মূর্তমান।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ব্যাপারে ভারত বা যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানও ইতিবাচক নয় বা এতদিন ইতিবাচক ছিল না বলে শোনা যায়। ভারতের অনেকের ধারণা, তারেক রহমান ক্ষমতায় গেলে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হতে পারে। ২০১১ সালের আগস্টে ফাঁস হওয়া উইকিলিকসের নথির তথ্যমতে, ঢাকায় মার্কিন কূটনীতিকরা বিএনপির পারিবারিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ উত্তরসূরিকে জঙ্গি মদদদাতাসহ নানান বিপজ্জনক অভিধায় চিহ্নিত করে ওয়াশিংটনকে সতর্ক করে লিখেছেন, তারেক যাতে সে দেশে ঢুকতে না পারেন।

তারেক রহমান বা বিএনপি নেতৃত্ব নিয়ে এত কথা অবতারণার কারণ, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রবিষয়ক তৎপরতায় বিএনপি কর্মীরা আশাবাদী হয়েছে। তাদের ভাষায়, যদি ‘সুষ্ঠু নির্বাচন’ হয় তারা ক্ষমতায় আসছে শিগগিরই। নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি, আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার বাংলাদেশ সফর– সবকিছু মিলিয়ে বিএনপি দারুণ আহ্লাদে আছে। ঢাকার কোনো কোনো পত্রিকায় দেখলাম, বিএনপি সম্ভাব্য মন্ত্রিসভা নির্ধারণের কাজও ইতোমধ্যে করছে। গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল কিনা জানি না, মন্ত্রিসভার কাজ যখন হচ্ছে, সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রীও নির্ধারণ করুক।

মনোয়ার রুবেল : কলাম লেখক

শেয়ার করুন