তাজউদ্দীন আহমদ: বঙ্গবন্ধুর প্রধান সিপাহসালার

মোহাম্মদ সজিবুল হুদা

প্রত্যেক জাতির জন্য কতগুলো ঐতিহাসিক দিবস থাকে, যে দিবস গুলোর সঙ্গে মিশে থাকে ঐ জাতির আবেগ ও আত্মমর্যাদা। ২৩ জুলাই, বাঙালি জাতির জন্য এমনই একটি আবেগময় ঐতিহাসিক দিন। ১৯২৫ সালের এই দিনে গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার দরদরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ। যিনি ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর থেকে ভাষার অধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনের একজন সম্মুখ সারির নেতা ছিলেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্ত ফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে তিনি সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ফকির আবদুল মান্নানকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে এমএলএ নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালে তরুণ তাজউদ্দীন আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক ও সমাজ সেবা সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশ নেন এবং কারাবরণ করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। ১৯৬৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। আজ এই মহান নেতার ৯৮তম জন্মবার্ষিকী। জন্মদিনে জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানকে আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।

universel cardiac hospital

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন একজন অন্যতম নায়ক। বাঙালির মুক্তির এই যুদ্ধে তিনি ছিলেন সংশপ্তকতুল্য। ১৯৭১ সালের নয় মাস তিনি নিজের পরিবারের জন্য সামান্য মুহূর্তও ব্যয় করেননি। চিরকুট লিখে পরিবারকে জানিয়ে দেন, যদি বেঁচে থাকি দেখা হবে দেশ স্বাধীনের পর। তাঁর এমন পণ বিরল দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া কিছু নয়। রাষ্ট্র পিতা (Founding father of the nation) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, আর তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন স্থপতির স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রধান সিপাহসালার। তার প্রখর নীতিবোধ, আত্মত্যাগ, স্বাধীনতার প্রশ্নে আপসহীন অবস্থান, জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে লক্ষ্যভেদী মনোভাব, দেশপ্রেম ও বুদ্ধিবৃত্তিক পথচলার কারণেই এতো দ্রুত সময়ের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

‘তাজউদ্দীন আহমদ আলোকের অনন্তধারা-প্রথম খণ্ড’ বইয়ে খান সারওয়ার মুরশিদ লিখেছেন, ‘আমার একটি কথা বিশেষভাবে মনে আছে, যে দিন ভারত আমাদেরকে স্বীকৃতি দিল, ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। ভারত যখন যুদ্ধের জন্য তৈরি, সেদিন তাজউদ্দীন কিন্তু কেঁদে ফেলেছিলেন সাংবাদিকদের সামনে। তাজউদ্দীনের সাথে শেখ সাহেবের কী যে সম্পর্ক ছিল সেটা আমি বুঝতে পারিনি। সেদিন তাজউদ্দীন না কাঁদলে আমি খুশি হতাম হয়তো। সেদিন তাজউদ্দীন বললেন, ‘বাংলাদেশের আজ জন্ম হল। পৃথিবীর একটি প্রধান রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল। এবং এই রাষ্ট্রের যিনি সত্যিকার জনক তিনি এই দৃশ্যটি দেখবার জন্য উপস্থিত নেই। আজ তাঁর অনুপস্থিতি আমি অন্তরাত্মা দিয়ে উপলব্ধি করছি।’ তাজউদ্দীনের চোখ দিয়ে বেশ খানিকটা জল গড়িয়ে পড়ল।

তাজউদ্দীন কন্যা সিমিন হোসেন রিমি তাঁর একটি লেখায় বলেছেন, ‘একদিন সন্ধ্যায় আমি লিপিদের (সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবের মেয়ে) ফ্ল্যাটে খেলছি, ওদের এক ভাই হঠাৎ দৌড়ে এসে বলল, আব্বা, আব্বা, তাজউদ্দীন চাচা এসেছেন। আমাদের ধারণা ছিল যাওয়ার সময় আব্বু একবার হয়তো আমাদের দেখে যাবেন। কিন্তু না, লিফটে ওঠার সময় দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের দিকে তাকিয়ে স্বভাবসুলভ একটু হেসে চলে গেলেন। এতেই আমাদের মন ভরে গেছে। আবার কিছুদিন পরে শুনেছি আব্বু সেখানে আবারও এসেছিলেন। কাজ সেরে চলে গেছেন, আমরা জানতেও পারিনি।’ এই হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর কর্তব্যবোধে অনন্য উদাহরণ। যেখানে দেশের তরে সন্তানের প্রতি পিতার স্নেহ-ভালোবাসাও তুচ্ছ।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর ৩ নভেম্বর জেলখানায় বন্দি অবস্থায় খুনি চক্রের হাতে জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামানের সঙ্গে নিহত হন তাজউদ্দীন আহমদ। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো- ৯৮তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার পরেও এই দিবসটি ঘিরে রাষ্ট্রীয়ভাবে, এমনকি দলটির পক্ষ থেকেও কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো কর্মসূচি আমাদের চোখে পড়েনি। একজন জাতীয় নেতাকে নিয়ে এমন উদাসীনতা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমাদের মনে রাখা উচিত, প্রত্যেক জাতিকেই সবার আগে চিনে নিতে হয় ঐ জাতির ইতিহাসের সঙ্গে মিশে থাকা নায়ক-মহানায়কদের। যে জাতি এ বিষয়ে উদাসীনতা দেখায়, সে জাতিকে দীর্ঘ মেয়াদে তার মাশুল গুণতে হয় কড়ায়-গণ্ডায়। তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন বাঙালির ইতিহাসের একজন অন্যতম নায়ক। বঙ্গবন্ধুর পর বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা। সুতরাং তাঁকে নিয়ে উদাসীনতা বাঙালির জন্য কোনো দৃষ্টিতেই গৌরবের নয়, একইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের জন্যও লজ্জার বিষয়।

আমরা আশা করব, তাজউদ্দীনসহ জাতির গৌরবময় ইতিহাসের সঙ্গে মিশে থাকা প্রত্যেক নেতাকে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের প্রতিটি রাজনৈতিক দল যথাযথ মর্যাদায় স্মরণ করবে এবং সবধরনের হীনমন্যতার উর্ধ্বে উঠে যার যা প্রাপ্য, তাঁকে সেই প্রাপ্য মর্যাদা প্রদান করবে।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক, মত ও পথ।

শেয়ার করুন