সাংবাদিকরা এখন মূল মানবাধিকারকর্মী: কামাল উদ্দিন

নিজস্ব প্রতিবেদক

মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, কমিশন মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পেলেই শোনে এবং সেগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সরকারকে সুপারিশ করে। সরকার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেয়। এখন সাংবাদিকরা মূল মানবাধিকারকর্মী। তাদেরকে বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। জামালপুরে সাংবাদিক গোলাম রব্বানিকে হত্যা করা হয়েছে।

তিনি বলেন, এখন ব্যাঙের ছাতার মতো বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন গড়ে উঠেছে, তারা কোনো কাজ করে না। অর্থের বিনিময়ে দুই পক্ষের সমঝোতা করে দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব সংগঠনের দিকেও নজর রাখতে হবে।

universel cardiac hospital

দেশের ৩৬টি জেলার তৃণমূল পর্যায়ের ৫০ জন মানবাধিকারকর্মীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ‘সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ’ (সিজিএস) গতকাল শনিবার এক গবেষণা প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে। রাজধানী ঢাকার একটি হোটেলে ‘প্রতিবাদীদের কে রক্ষা করবে, বাংলাদেশে মানবাধিকারকর্মীদের দুর্দশা’ শিরোনামে জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশের অনুষ্ঠানে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন।

জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, মানবাধিকারকর্মীদের কাজে ৬৫ শতাংশ ক্ষেত্রে বাধা এসেছে রাষ্ট্রীয় সংস্থা ও ক্ষমতাসীন দল থেকে। এর মধ্যে ৪১ শতাংশ ক্ষেত্রে কাজে বাধা দিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তারা। নানা ধরনের বাধা ও হুমকির মুখে প্রতি ১০ জন মানবাধিকারকর্মীর ১ জনকে এলাকা ছাড়তে হয়েছে। সাক্ষাৎকার দেওয়া ৪৬ শতাংশ মানবাধিকারকর্মী বলেছেন, দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত বক্তারা মানবাধিকারকর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। এই পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন অংশীদারের মধ্যে সংলাপ আয়োজনের ওপর জোর দেন তারা।

জরিপটি পরিচালনা করা হয় এ বছরের গত ২৪ মে থেকে গত ২৫ জুনের মধ্যে। জরিপে অংশ নেওয়া মানবাধিকারকর্মীদের ৭৯ শতাংশের মানবাধিকারকাজে ১০ বছরের বেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে। ১৪ শতাংশ মানবাধিকারকর্মী ছিলেন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্য, ২০ শতাংশ ছিলেন নারী।

গবেষণা প্রতিবেদনে নেতৃত্ব দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এই জরিপের মাধ্যমে দেশে মানবাধিকারকর্মীদের কাজের চ্যালেঞ্জের বিষয়গুলো তুলে আনা হয়েছে। সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় মানবাধিকারকর্মীরা ভয়ে কোনো কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি। এ থেকে বোঝা যায়, পরিস্থিতি আসলে কোন পর্যায়ে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৩ শতাংশ ক্ষেত্রে ধর্মীয় কাজে যুক্ত ব্যক্তি, উগ্রপন্থী ও অপরাধীদের মাধ্যমে; ৯ শতাংশ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী ও ব্যবসার স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী; ৬ শতাংশ ক্ষেত্রে বিরোধী দল এবং প্রায় ৭ শতাংশ ক্ষেত্রে অন্যান্য কারণে মানবাধিকারকর্মীরা কাজে বাধার মুখে পড়েন। কাজের কারণে মানবাধিকারকর্মীদের সবচেয়ে বেশি ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে হুমকির সম্মুখীন হতে হয়েছে। এ ছাড়া শারীরিক আঘাত, চাঁদাবাজি, হয়রানি, গ্রেপ্তার, শোষণের শিকার হতে হয়েছে তাদের। প্রতি ১০ জন মানবাধিকারকর্মীর ১ জনের পরিবারের সদস্য ও বন্ধুরাও হয়রানির শিকার হয়েছেন।

অনুষ্ঠানে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) চেয়ারপারসন জেড আই খান পান্না বলেন, বিচারিক বিভাগের ওপর কারও কোনো আস্থা আছে বলে মনে হয় না। দেশ চলছে পুলিশের মাধ্যমে, আমলাদের মাধ্যমে। এখন টাকা থাকলে দলের মনোনয়ন কেনা যায়। রাজনীতি চলছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের হাতে। আইনের শাসনই মানবাধিকারকর্মীদের বাঁচাতে পারে।

ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ–এর সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, সরকারগুলো মানবাধিকারকর্মীদের ‘দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে’, ‘দেশের শত্রু’ বলে ‘আখ্যায়িত’ করে। ব্যক্তিদের ভয় দেখাতে তারা এটা করে। সরকারগুলো চায় না এই ব্যক্তিরা সত্য তথ্য ছড়াক। সংলাপের আয়োজন করে এসব নিয়ে কথা বলা দরকার।

বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) সম্মানসূচক নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন বলেন, অতীতেও বিভিন্ন সরকারের সময়ে মানবাধিকারকর্মীদের কাজে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে, বাধা দেওয়া হয়েছে। আগে অনেক মানবাধিকার সংস্থার বিদেশি সহায়তাও আটকে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। অতীতের সেসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়া উচিত নয়। এখন অনেক আইন হয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে আইনি প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। বিচারিক হয়রানি হচ্ছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ কোন প্রতিষ্ঠানের কাছে গিয়ে করতে হবে, তা পাওয়া যায় না। তিনি এই পরিস্থিতির মধ্যে সংলাপে বসার আহ্বান জানান।

কামাল উদ্দিন আহমেদ ও সারা হোসেন অতীতে অন্য সরকারগুলোর সময়ে দীর্ঘ সময় ধরে মানবাধিকারকাজে যুক্ত কর্মীদেরও জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেন। এর জবাবে অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, জরিপে ৩৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন এবং ১৫–২০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কয়েকজন মানবাধিকারকর্মীও রয়েছেন।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান বলেন, দেশে ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে মানবাধিকারকর্মীরা সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। জাতিসংঘ এ বিষয়ে কয়েকবার বাংলাদেশকে সতর্ক করেছে

শেয়ার করুন