বিশ্বব্যাপী টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে সম্মিলিতভাবে প্রয়োজনীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ইতালির রোমে জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)-র সদর দফতরে তিন দিনব্যাপী খাদ্য ব্যবস্থাপনা শীর্ষ সম্মেলন +২ স্টকটেকিং মোমেন্টে (ইউএনএফএসএস+২) সোমবার অংশ নিয়ে এ আহ্বান জানান শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রবিবার বিকালে রোমে পৌঁছান। তিনি এফএও সদর দফতরে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন এবং বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের কৃষিখাত এরই মধ্যে তার জলবায়ু অভিযোজন সক্ষমতা অনেকাংশে প্রমাণ করেছে। জলমগ্ন এলাকায় আমাদের সনাতনী ‘ভাসমান কৃষি পদ্ধতি’ ২০১৫ সালে এফএও কর্তৃক কৃষিতে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃত হয়।
তিনি বলেন, আমরা এগ্রো-ইকোলজিকাল জোনস-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাচ্ছি। জৈবসার উৎপাদন, ফসলী জমির বৈচিত্র্য, বিরূপ-পরিস্থিতি সহনশীল জাত উদ্ভাবন, সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা এবং প্রজনন ক্ষেত্রগুলোর সুরক্ষা, বৃষ্টির পানি সংগ্রহ এবং ম্যানগ্রোভ বাগান প্রস্তুতকরণসহ বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। ইতোমধ্যে কৃষি উৎপাদনে সমলয়সহ (সিনক্রোনাইজেশন) বিভিন্ন আধুনিক পদ্ধতির প্রচলন এবং স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্মতভাবে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের চাষীগণ যথেষ্ট বিচক্ষণতার পরিচয় দিচ্ছেন। আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের তরুণ সমাজ কৃষিক্ষেত্রে যুক্ত হয়ে ‘স্মার্ট কৃষি’ বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে এসেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কৃষি ও খাদ্যপণ্যের রপ্তানি বাড়াতে উৎপাদন হতে শিপমেন্ট পর্যন্ত আমরা উত্তম কৃষি চর্চা, হাইজিন প্র্যাকটিসেস, গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিসেস অনুসরণ করছি। এছাড়াও, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন অ্যাক্রিডিটেড ল্যাব স্থাপন করে দেশি পণ্যের মান নিশ্চিত করার দিকে মনোনিবেশ করছি।
বাংলাদেশ সরকার কৃষি প্রক্রিয়া জাতকরণে বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এছাড়াও, আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আমাদের কৃষি উদ্ভাবন ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে আমাদের আগ্রহের কথা জানিয়ে আসছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বৈশ্বিকভাবে ৬৯০ মিলিয়ন মানুষ এখনও অপুষ্টিতে ভুগছে, প্রায় দুই বিলিয়ন মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নেই এবং প্রায় তিন বিলিয়ন মানুষ সুষম খাবার থেকে বঞ্ছিত। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ এবং নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা-নিষেধাজ্ঞার ফলে সৃষ্ট খাদ্য, সার, জ্বালানি ও আর্থিক সংকট বিশ্বজুড়ে ক্ষুধা ও অপুষ্টির সমস্যাকে ঘনীভূত করেছে। তবে, পুষ্টিকর খাবার সংগ্রহের অক্ষমতার জন্য কৃষি ও খাদ্যপণ্যের মূল্য একমাত্র প্রতিবন্ধকতা নয়। এজন্য প্রয়োজন সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই খাদ্য ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন।
এ প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী টেকসই, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পাঁচটি প্রস্তাবনা পেশ করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। প্রথমত, আধুনিক কৃষিতে বিনিয়োগের জন্য বহুপাক্ষিক উন্নয়ন ব্যাংক এবং বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আর্থিক প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা প্রদান করা; দ্বিতীয়ত, জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্যোগে ‘ব্ল্যাক সি গ্রেইন ডিল’কে চালু রাখার পাশাপাশি খাদ্য ও সার রপ্তানির বিধি-নিষেধগুলো তুলে নেওয়াসহ যেকোন বাণিজ্য বাধা অপসারণের লক্ষ্যে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া;
তৃতীয়ত, জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক ‘ফুড ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থার রূপান্তরের লক্ষ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সহায়তায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসা;
চতুর্থত, কৃষিশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে তাল রেখে ন্যানো-প্রযুক্তি, বায়ো-ইনফরমেটিক্স ও অত্যাধুনিক কৃষি প্রযুক্তিগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া বাঞ্ছনীয়।
পঞ্চমত, প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের অপচয় রোধে তরুণ সমাজকে অন্তর্ভুক্ত করার মধ্য দিয়ে ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি বলে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।
এই সম্মেলনে ২০ টিরও বেশি রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানসহ ১৬০ টিরও বেশি দেশ থেকে প্রায় দুহাজার প্রতিনিধি অংশ নিচ্ছেন। ইতালিতে আয়োজিত এই শীর্ষ সম্মেলন আনুষ্ঠানিকভাবে স্থানীয় সময় ১৪:৩০টায় উদ্বোধন করেন জাতিসংঘ মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেস এবং ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি। এছাড়া উদ্বোধনী আয়োজনে এফএও-এর মহাপরিচালক, কু ডংইউ এবং ইথিওপিয়া, বাংলাদেশ, সামোয়া এবং নেপালের প্রধানমন্ত্রীসহ বেশ কিছু দেশের সরকার প্রধানগণও অংশ নেন।
তিন দিন ধরে উচ্চ-পর্যায়ের এ বৈঠকের লক্ষ্য হল ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম খাদ্য ব্যবস্থাপনা শীর্ষ সম্মেলনের পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতিগুলোর অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে দেশগুলোর জন্য একটি অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করা এবং স্থায়ী বাধা ও সাফল্য চিহ্নিত এবং অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠা করা।