বিশ্ববাজারে আর্থিক মন্দায়ও ৪৭৯০ কোটি টাকার মাছ রপ্তানি

মত ও পথ ডেস্ক

মাছ
ফাইল ছবি

বিশ্ববাজারে আর্থিক মন্দা সত্ত্বেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬৯ দশমিক ৮৮ হাজার মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে দেশের আয় হয়েছে ৪ হাজার ৭৯০ কোটি ৩০ লাখ টাকা। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সর্বশেষ তথ্য বলছে, করোনা মহামারির মধ্যেও বিশ্বের যে তিনটি দেশ মাছ উৎপাদনে সাফল্য দেখিয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার ২০২২’ শীর্ষক বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চাষের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে (ছয় বছর ধরে পঞ্চম অবস্থানে ছিল) রয়েছে। এটি মৎস্য খাতের অনন্য এক অর্জন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এছাড়াও স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। ইলিশ আহরণে প্রথম (বর্তমানে ইলিশের মোট উৎপাদন ৫.৭১ লাখ মেট্রিক টন) অবস্থানে রয়েছে।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা মৎস্যজাত পণ্যের প্রায় ৭০ ভাগ ভ্যালু অ্যাডেড প্রোডাক্টস। বাংলাদেশ থেকে সাধারণত আইকিউএফ, কুকড, ফিস ফিলেট ভ্যালু অ্যাডেড মৎস্য জাতীয় পণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ থেকে মূলত গলদা, বাগদা, হরিণাসহ বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি, স্বাদু পানির মাছ যেমন- রুই, কাতলা, মৃগেল, আইড়, টেংরা, বোয়াল, পাবদা, কৈ প্রভৃতি এবং সামুদ্রিক মাছের মধ্যে ভেটকি, দাতিনা, রূপচাঁদা, কাটল ফিস, কাঁকড়া রপ্তানি হয়ে থাকে। এছাড়াও শুঁটকি, মাছের আঁইশ এবং চিংড়ির খোলসও রপ্তানি হয়ে থাকে। প্রাকৃতিক উৎস থেকে আহরিত কাঁকড়া ও কুঁচিয়া বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে।

মৎস্যখাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিরাপদ ও গুণগত মানসম্পন্ন মৎস্য ও মৎস্য পণ্যের উৎপাদন নিশ্চিত করা মৎস্য অধিদপ্তরের অন্যতম ম্যান্ডেট। এ লক্ষ্যে বর্তমানে দেশে চিংড়ি উৎপাদনের সব স্তরে উত্তম মৎস্য চাষ অনুশীলন এবং হ্যাজার্ড অ্যানালাইসিস অ্যান্ড ক্রিটিক্যাল কন্ট্রোল পয়েন্ট (এইচএসিসিপি) ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয়েছে। মৎস্য খাদ্য ও পশু খাদ্য আইন এবং বিধিমালা, মৎস্য হ্যাচারি আইন ও বিধিমালা বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিরাপদ মাছ উৎপাদন নিশ্চিতকরণ সহজতর হচ্ছে।

রপ্তানি করা মৎস্য ও মৎস্য পণ্যের ট্রেসেবিলিটি সিস্টেম কার্যকর করার অংশ হিসেবে ইতো মধ্যে প্রায় ২ লাখ ৭ হাজার চিংড়ি খামার এবং ৯ হাজার ৬৫১টি বাণিজ্যিক মৎস্য খামারের রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়েছে। ক্ষুদ্র এবং মাঝারি চিংড়ি চাষিদের নিয়ে ৩০০টি ক্লাস্টার গঠন করে ই-ট্রেসেবিলিটি কার্যক্রম পাইলটিং করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নিরাপদ ও মানসম্মত চিংড়ি উৎপাদন নিশ্চিতকরণে ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর ম্যানুয়াল’ প্রণয়ন করা হয়েছে।

মৎস্য চাষে ওষুধের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘অ্যাকোয়াকালচার মেডিসিনাল প্রোডাক্টস নিয়ন্ত্রণ নির্দেশিকা’ প্রণয়ন করা হয়েছে এবং মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে। মৎস্য হ্যাচারি থেকে শুরু করে মাছ চাষ ও প্রক্রিয়াকরণে জড়িত সব স্থাপনা কার্যকরভাবে পরিদর্শনের জন্য ফিশ অ্যান্ড ফিশারি প্রোডাক্টস অফিসিয়াল কন্টোল প্রটোকল অনুসরণ করা হচ্ছে। মৎস্য অধিদপ্তরের নিরাপদ মৎস্য ও মৎস্য পণ্য উৎপাদন নিশ্চিতকরণে ২০০৮ সাল থেকে ন্যাশনাল রিডিউস কন্ট্রোল প্ল্যান (এনআরসিপি) অনুযায়ী, মাছ ও চিংড়ির নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য ৫২টির অধিক দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এসব দেশের মধ্যে নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত, ফ্রান্স, আমেরিকা, জাপান ও রাশিয়া অন্যতম। নেদারল্যান্ডস বাংলাদেশের মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্যের শীর্ষ আমদানিকারক দেশ।

মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট মৎস্য উৎপাদিত হয়েছে ৪৭ দশমিক ৫৯ লাখ মেট্রিক টন যা ২০০৭-০৮ অর্থবছরের মোট উৎপাদনের (২৫.৬৩ লাখ মেট্রিক টন) চেয়ে ৮৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ বেশি এবং ২০১০-১১ অর্থবছরের মোট উৎপাদনের (৩০.৬২ লাখ মেট্রিক টন) চেয়ে ৫৫ দশমিক ৪২ শতাংশ বেশি। মাথাপিছু দৈনিক মাছ গ্রহণের পরিমাণ চাহিদার (৬০ গ্রাম/দিন/জন) বিপরীতে বৃদ্ধি পেয়ে ৬৭ দশমিক ৮০ গ্রামে উন্নীত হয়েছে। দেশের মোট জিডিপির ২ দশমিক ৪৩ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপির ২২ দশমিক ১৪ শতাংশ মৎস্য উপ-খাতের অবদান। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৪ লাখ নারীসহ ১৯৫ লাখ বা প্রায় ১২ শতাংশের অধিক মানুষ এ সেক্টরের বিভিন্ন কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়োজিত থেকে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছে।

সুনীল অর্থনীতির বিকাশে সমুদ্রে প্রচলিত ও অপ্রচলিত মৎস্য সম্পদ অনুসন্ধান, সংরক্ষণ ও টেকসই আহরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ উন্নয়ন কর্মকৌশল প্রণয়ন এবং তা এসডিজির সঙ্গে সমন্বয় করে হালনাগাদ করা হয়েছে। এরই মধ্যে সামুদ্রিক মৎস্য আইন ২০২০ ও সামুদ্রিক মৎস্য বিধিমালা ২০২২ প্রণয়ন হয়েছে। দেশের সমুদ্রসীমায় মনিটরিং, কন্ট্রোল ও সার্ভিল্যান্স জোরদারকরণে ১০ হাজার আর্টিসানাল মৎস্য নৌযান ও পাঁচটি বাণিজ্যিক মৎস্য নৌযান প্রযুক্তিভিত্তিক ভেসেল মনিটরিং সিস্টেমের আওতায় আনা হয়েছে।

শেয়ার করুন