জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতিতে প্রমোদ ভ্রমণ কি মন্ত্রীর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে?

হাসান শান্তনু

চলতি মাসের শুরুতে ডেঙ্গুর তাপে যখন দেশ পুড়ছিলো, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক তখন সপরিবারে মালয়েশিয়ায় প্রমোদ ভ্রমণে ব্যস্ত ছিলেন। এটা তাঁর পুরনো অভ্যাসের ধারাবাহিক কাণ্ড। ২০১৯ সালে ডেঙ্গুজ্বরের সংক্রমণ, এমনকি করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সময়ও তিনি বিবি-আওলাদসহ বিদেশে অবকাশযাপনে মত্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পরের পাঁচ দশকের মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব যারা পালন করেছেন, তাদের কম-বেশি সাফল্য-ব্যর্থতা আছে। কিন্তু জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতির কালে জাহিদ মালেকের মতো মন্ত্রিসভার কোনো সদস্যের ‘বিলাসী অবসর’ কাটাতে বিদেশে চলে যাওয়ার মতো বালখিল্য আচরণ করার রেকর্ড নেই।

ডেঙ্গুর বিস্তার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে পেরুর স্বাস্থ্যমন্ত্রী রোজা গুতিয়ারেজ গত জুলাই মাসে পদত্যাগের প্রায় একমাস পর এ দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক দায়দায়িত্বের বিষয়ে এক ‘নতুন রেকর্ড’ শুনিয়েছেন জনসাধারণকে। চলতি বছর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আগের যে কোনো বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ৬৩ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। সেই সঙ্গে বাড়ছে রোগটিতে মৃত্যু, আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুতগতিতে ছড়াচ্ছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এবারের সংক্রমণকে ‘দেশে এখন জনস্বাস্থ্য জরুরি পরিস্থিতি চলছে’ বলে চিহ্নিত করছেন। যা জাতীয় উদ্বেগের বিষয়। ডেঙ্গু নিয়ে জনমনে উদ্বেগ যেমন বাড়ছে, সেই সঙ্গে এ ধরনের বিপজ্জনক পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে, সেই প্রশ্ন ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।

universel cardiac hospital

এমন পরিস্থিতিতে জাহিদ মালেকের ‘নয়া তত্ত্ব’ হচ্ছে- ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ চিকিৎসাসেবা দেওয়া।’ অথচ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্বের মধ্যে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে কাজ করার কথা। তবে ঢাকাসহ অন্যান্য সিটি কর্পোরেশন এলাকায় মশা নিধনের দায়িত্ব স্থানীয় সরকার ও পল্লি উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের। এডিস প্রজাতির মশা কামড়ালে মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। তাই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে সমন্বয়ের দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। সমন্বয়ের দায়িত্বটা কোনো মন্ত্রণালয়ের শীর্ষপর্যায়ের কেউ পালন করতে না পারলে সেই দায়িত্বে তার থাকার দরকার আসলে কোন জায়গায়, এর উত্তর জনস্বাস্থ্যের প্রশ্নে জাহিদ মালেকের খোলাসা করা জরুরি।

যক্ষ্মা, এইচআইভি-এইডস, ম্যালেরিয়াসহ বিভিন্ন রোগ নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জাতীয় কর্মকৌশল থাকার মতো প্রায় দুই মেয়াদে এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থেকেও জাহিদ মালেক ডেঙ্গু নিয়ে তেমন কর্মকৌশল নির্ধারণে নেতৃত্ব দিতে পারেননি। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরনের (ভেরিয়েন্ট) মধ্যে দেশে এ বছর কোন ধরনটির প্রাদুর্ভাব বেশি, এটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখনো চিহ্নিত করতে পারেনি। স্বাস্থ্যখাতের প্রধানকর্তা হিসেবে এ ব্যর্থতার দায় কি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নয়? ডেঙ্গুর ভয়াবহতা দেশে প্রথম বেশি হয় ২০০০ সালে। এরপর সবচেয়ে বড় আঘাত হানে ২০১৯ ও ২০২২ সালে। শেষের দুই বছরের সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন জাহিদ মালেক; শুধু তাই নয়, তিনি প্রায় এক দশক ধরে ওই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন। এ সময়ের মধ্যেও তিনি দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে পারেননি। প্রতি বছর এ ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের যে সংখ্যা বলা হয়, তা আংশিক।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিদিন রাজধানীর ২০টি সরকারি হাসপাতাল, ৪২টি বেসরকারি হাসপাতাল আর ঢাকার বাইরের মাত্র ৭১টি হাসপাতালের ডেঙ্গু রোগীর তথ্য প্রকাশ করে। এগুলোর বাইরে ঢাকাসহ সারাদেশের হাজারো সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা চিকিৎসা নিলেও তারা সরকারি হিসাবের বাইরে থাকেন। দেশের সব হাসপাতালকে ডেঙ্গু রোগীর বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে তথ্য জানাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কয়েকবার নির্দেশ দেয়। সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ উপেক্ষা করলেও জবাবদিহির মুখোমুখি এ পর্যন্ত একটাকেও হতে হয়নি। জনস্বাস্থ্য বিশারদদের মতে, যে কোনো রোগের সংক্রমণ মোকাবিলায় রোগটির বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য না থাকলে তা মোকাবিলা দুরুহ হয়ে ওঠে।

ক্ষুদ্রতর প্রজাতির হলেও মশাকে বলা হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণি। বৈশ্বিক নানা পরিসংখ্যানে ধারণা দেওয়া হয়, পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যতো মানুষ জন্মেছেন, তাদের মধ্যে অন্তত অর্ধেক মারা গেছেন মশাবাহিত রোগে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র মতে, মশাবাহিত রোগে বিশ্বে বছরে প্রায় ৭ লাখ ২৫ হাজার লোক মারা যান। অন্যদিকে বিষধর সাপের ছোবল; কুকুর, কুমির, জলহস্তী, সিংহ, নেকড়ে, হাঙরের কামড় ও আক্রমণ সম্মিলিতভাবে অন্তত ৭৫ হাজার জনের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে মশা নিয়ন্ত্রণ তাই গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্যের বিষয়।

বিশেষজ্ঞরা অনেক আগে থেকেই বলছেন, দেশে মশাবাহিত রোগের বিষয়ে গবেষণা, মশার কীটনাশক নিয়ে গবেষণা ও বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ চালানোর জন্য জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান হওয়া প্রয়োজন। এসব কাজ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন হলেও মন্ত্রণালয় সেসবের ধারে-কাছেও নেই। এ ব্যর্থতার দায় কি কোনো তত্ত্ব হাজির করে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এড়ানোর সুযোগ আছে? ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে ২০১৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘মধ্যবর্তী পরিকল্পনার’ পরামর্শ দেয়। এতে স্বাস্থ্য ছাড়া আরো আটটি মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করার কথা বলা হয়। কোন মন্ত্রণালয় কী ভূমিকা ও দায়িত্ব পালন করবে, তাতে তা–ও সংক্ষিপ্ত আকারে বলা হয়। এ পরিকল্পনা নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কোনো কাজই হয়নি।

হাসান শান্তনু: সাংবাদিক ও গণমাধ্যম গবেষক।

শেয়ার করুন