কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও ভিয়েনা কনভেনশন

এ কে এম আতিকুর রহমান

এ কে এম আতিকুর রহমান
এ কে এম আতিকুর রহমান

গত ১৭ জুলাই ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের দিন বনানীর একটি ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনের সময় আশরাফুল আলম (হিরো আলম) নামের একজন প্রার্থীকে কিছু লোক মারধর করে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড অবশ্যই নিন্দনীয় এবং একটি জঘন্য অপরাধ। শুধু নির্বাচনের প্রার্থী কেন, সাধারণ একজন ভোটারের ওপরও কেউ হামলা চালাতে পারে না।

আমরা জানি, সন্দেহভাজন হামলাকারীদের এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে দেশের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শুধু হামলাকারীদের বিচারের আওতায় আনলেই হবে না, পেছনের ইন্ধনদাতাদেরও শাস্তি দিতে হবে। তবে দলমত বা সামাজিক মর্যাদা-নির্বিশেষে বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিকেরই নির্ভয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের অধিকার রয়েছে এবং তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব।
আমাদের দেশে আইন রয়েছে।

universel cardiac hospital

সে আইন অনুসারে ওই হামলাকারীদের শাস্তি হবে। আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নন। এ ব্যাপারে সরকারের বিন্দুমাত্র গাফিলতি নেই। কিন্তু সেই ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি দূতাবাসের বিবৃতি দেওয়া অবশ্যই কূটনৈতিক শিষ্টাচারের লঙ্ঘন।

তাও আবার জোট বেঁধে। আমার এক সাংবাদিক বন্ধু একে ১২ দলীয় জোট হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ঠিক আমাদের দেশে বা প্রতিবেশী ভারতে নির্বাচন বা কোনো রাজনৈতিক দাবিদাওয়া উপলক্ষে যেমন কয়েকটি রাজনৈতিক দল মিলে একেকটি জোট তৈরি করে থাকে। জানি না, বিদেশি দূতাবাসের এমন জোট গঠনের ইতিহাস অন্য দেশেও আছে কি না। যদি তা না হয়, তাহলে তারা পাকিস্তান, নেপাল বা শ্রীলঙ্কায় এমনটি করছে না কেন? তবে এটা কি অন্য কারণে বাংলাদেশকে চাপ দেওয়ার জন্য? কিছু বিশ্লেষক বলছেন, তারা বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনা করে এ ধরনের চাপ দিয়ে থাকতে পারে।

তারা দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে চীন ও রাশিয়ার গভীর মনোযোগ এবং সংশ্লিষ্টতার প্রতি দৃষ্টি রাখছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং চীনের গতিবিধিতে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততার সমীকরণ হয়তো তাদের চিন্তায় ফেলেছে এবং তারা ভেতরে ভেতরে শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে আছে; যদিও সেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের অত্যন্ত চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে।

এ বিবৃতি নিয়ে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও আরো দু-একজন মন্ত্রী মন্তব্য করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের কাছে প্রশ্ন রেখেছেন, যাঁরা ওই বিবৃতি দিয়েছেন তাঁদের দেশে যখন মানুষকে গুলি করে মারা হয় তখন কি সেই দেশে কর্মরত কূটনীতিকরা এমন দল বেঁধে বিবৃতি দেন? এভাবে বিবৃতি প্রদান গ্রহণযোগ্য নয় এবং এসব বন্ধ করার সময় এসে গেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে আমি ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের অনুচ্ছেদ-৪১.১ কী বলছে তা উল্লেখ করতে চাই। ওই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কূটনৈতিক সুযোগ-সুবিধা ও অনাক্রম্যতা উপভোগ করা সব ব্যক্তির কর্তব্য হচ্ছে তাঁদের কর্মরত দেশের আইন ও প্রবিধানকে শ্রদ্ধা করা। এ ছাড়া কর্মরত রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করাও তাঁদের (কূটনীতিকদের) একটি দায়িত্ব। কিন্তু বাংলাদেশে কর্মরত রাষ্ট্রদূতদের ভিয়েনা কনভেনশনের অন্যান্য অনুচ্ছেদ, যেগুলো তাঁদের সুযোগ-সুবিধা, প্রাধিকার ও অব্যাহতি (ইমিউনিটিজ) উপভোগ করা সম্পর্কিত, পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ করলেও তাঁরা কি উদ্দেশ্যে ৪১ নম্বর অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করছেন জানি না। তাঁরা কি মনে করেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ইচ্ছা করলেই হস্তক্ষেপ করা যায়? বাংলাদেশ কি তাঁদের দেশের মতোই একটা স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র নয়? এ প্রসঙ্গে ভিয়েনা কনভেশনটির শুরুতে বলা হয়েছে, কনভেনশনটি প্রণয়নের উদ্দেশ্য হচ্ছে রাষ্ট্রের সার্বভৌম সমতা, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষণাবেক্ষণ এবং দেশগুলোর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উন্নয়ন। আর সেই পবিত্র ও কঠিন দায়িত্বটি বর্তায় কূটনীতিকদের ওপর। সেই দায়িত্বের প্রতি মনোনিবেশ করলেই বোধ হয় কূটনীতিকদের জন্য যেমন ভালো, তেমনি আমরাও ভালো থাকব।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিদেশি কূটনীতিকদের এসব কর্মকাণ্ডের অর্থাৎ আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর সুযোগ করে দিয়েছি আমরাই। আমরা আমাদের দেশের ভাবমূর্তি বা সম্মানের কথা চিন্তা করলে কখনো কি নিজেদের ভেতর কোনো সমস্যা হলেই বিচার দেওয়ার জন্য বিদেশি দূতাবাসে ছুটে যেতাম? তারা কি এ দেশের মা-বাবা, রক্ষাকর্তা? নাকি তাদের অঙ্গুলি হেলনে দেশ চলে? আমাদের আত্মসম্মানবোধ কি কখনোই জাগ্রত হবে না? এই কি আমাদের দেশপ্রেম, দেশের প্রতি ভালোবাসা? দেশকে আমরা আর কত নিচে নামাব? একটা কথা আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, দেশের সম্মান নষ্ট হলে আমাদেরও কোনো সম্মান থাকে না। বিদেশিরা আমাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে, বিন্দুমাত্র সম্মান করবে না।

শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশেই মিডিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে বাস্তবতার নিরিখে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে মিডিয়ার অবদান অনস্বীকার্য। একজন গণমাধ্যমকর্মী দেশেরও একজন নাগরিক। স্বভাবতই তিনি দেশকে ভালোবাসেন, দেশপ্রেমের কোনো ঘাটতিই তাঁর মধ্যে নেই। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে মিডিয়া সমাজের অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি অবদান রাখতে পারে। শুধু বিদেশি দূতাবাসেরই নয়, দেশের সম্মান ক্ষুণ্ন বা ভাবমূর্তি নষ্ট করে এমন কোনো গুরুত্বহীন সংবাদ পরিবেশনের বিষয়টি তাদের সতর্কতার সঙ্গে দেখতে হবে। বর্তমান বিশ্বে মিডিয়া একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ক্ষেত্র। সভ্য সমাজে মিডিয়ার মতো এত বড় অস্ত্র যেমন নেই, তেমনি এমন জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রদর্শকও নেই। তাই দেশ ও জনগণের স্বার্থে তাদের যথাযথ ভূমিকা একান্তই কাম্য।

বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি কূটনীতিকদের প্রথম কাজটিই হচ্ছে তাঁদের দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে দৃঢ়তর ও সম্প্রসারিত করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তাইতো ভিয়েনা কনভেনশনের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, এটি দেশগুলোর সাংবিধানিক ও সামাজিক কাঠামোর ভিন্নতা সত্ত্বেও দেশগুলোর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উন্নয়নে অবদান রাখবে বলে বিশ্বাস করে। এ ক্ষেত্রে পারস্পরিক স্বার্থ সংরক্ষণ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সহযোগিতা ও সমর্থন অবশ্যই গুরুত্ব পেয়ে থাকে। তাঁদেরকে যেমন এ দেশের মানুষ ও রাজনীতিকে বুঝতে হবে, তেমনি এ দেশের সমাজব্যবস্থাকেও জানতে হবে। তাঁদের মনে রাখতে হবে, তাঁরা ভিন্ন একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও আর্থ-সামাজিক পরিবেশের মধ্যে এসে পড়েছেন। তাঁদের এমন কোনো কাজ করা সমীচীন হবে না, যাতে দুই দেশের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। উন্নয়ন ও কল্যাণমূলক পরামর্শ দোষের কিছু নয়, তবে তা হতে হবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের আবহে, খবরদারির দৃষ্টিতে নয়।

আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সব সময়ই অতি উৎসাহী লোকজন বা কর্মীদের বিচরণ দেখা যায়। তারা যেকোনো অজুহাতেই দলের ক্ষতি হয় এমন কাজ করে বসে। এদের থেকে সাবধান না হলে তার খেসারত দলকে দিতেই হবে। রাজনীতিতে সহনশীলতা থাকা খুবই জরুরি। রাজনৈতিক দর্শনে ভিন্নতা থাকা স্বাভাবিক। তাইতো একটি দেশে অনেক রাজনৈতিক দল দেখা যায়। তবে সবার একটি অভিন্ন দর্শন থাকতে হবে, সেটি হলো দেশপ্রেম। এ ক্ষেত্রে আপস করলে দেশের ক্ষতি ছাড়া কখনোই কল্যাণ বয়ে আনবে না। আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের নাক গলানিও থামবে না।

লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব

শেয়ার করুন