সব পক্ষের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

সুষ্ঠু নির্বাচন বলতে যা বোঝায়, আমাদের দেশে অতীতের অনেক নির্বাচন সেই অর্থে অনেকের কাছে পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য হয়নি। তার মানে এই নয় যে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু বা গ্রহণযোগ্য হয়নি। হ্যাঁ, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেওয়ার জন্য বেশ কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। সেই শর্তগুলো আইন দ্বারা রক্ষা করার বিধান থাকার পরও যখন তা লঙ্ঘিত হয়, তখনই নির্বাচনে কোনো না কোনো পক্ষের হস্তক্ষেপ নির্বাচনের বাস্তব চিত্রকে প্রতিফলিত করতে দেয় না।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও এ ধরনের ঘটনা আমাদের দেশে অনেক নির্বাচনের ক্ষেত্রে অতীতে ঘটেছে। ফলে ওই সব সময়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা অনেক ক্ষেত্রেই লঙ্ঘিত হয়েছে।
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ১৯৯১ সালে নির্দলীয় সরকারব্যবস্থার আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল। মানুষের মনেও অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় একটি প্রত্যাশা জন্ম নিয়েছিল।

কিন্তু সেই নির্দলীয় সরকারের অধীনে প্রতিষ্ঠিত দলীয় সরকারের শাসনকালে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন ইত্যাদিতে সুষ্ঠু নির্বাচন ধারণাটি অনুপস্থিত হতে দেখা যায়। জোরজবরদস্তির ঘটনা ঘটে। তা থেকেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ধারণার দাবি করা হলে তা তৎকালীন সরকার প্রত্যাখ্যান করেছিল। মানুষের কাছে তখন সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ১৯৯১-এর অভিজ্ঞতার একটি সাংবিধানিক ধারার প্রয়োজনীয়তা গুরুত্ব পায়। সে জন্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য দেশে আন্দোলন করতে দল-মত-নির্বিশেষে সবাইকে একত্র হতে দেখা যায়। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সব বিরোধী দলের বর্জনের মুখে পড়ে। কিন্তু সরকার ভোটার বিবর্জিত অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ গঠন করে। প্রতিক্রিয়া সামাল দিতে না পেরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু নিজেদের বৈধতা জনগণের কাছে না থাকায় অসহযোগ আন্দোলনের মুখে পড়ে।

বাধ্য হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নতুন ব্যবস্থায় জাতীয় সংসদের নতুন নির্বাচনের সুযোগ করে দিতে। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার প্রথম নির্বাচনের আয়োজনকালেই সরকার উত্খাত এবং নির্বাচন পণ্ড করার অপচেষ্টা চলে। সেই অপচেষ্টা রোধ করা হয়, নির্বাচনটিও সুষ্ঠু পরিবেশে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। ধারণা ছিল যে নানা সীমাবদ্ধতার পরও তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কিছুকাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে। নির্বাচিত সরকারের সময়ের উপনির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে খুব বেশি সমালোচনা ছিল না। কিন্তু দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানে সদ্যোবিদায়ি সরকারি দল নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে। ২০০১ নির্বাচনের পরিবেশ, ফলাফল অনেক ক্ষেত্রেই বড় ধরনের প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। বিজয়ী দল নির্বাচন-পরবর্তী পরিবেশকে ভয়ানক রকম নির্যাতন, হামলা ও সাম্প্রদায়িকতার এক স্বপ্নের অতীত অভিজ্ঞতা তৈরি করেছিল।

এরপর ক্ষমতাসীন সরকার গোটা শাসনামলে নির্বাচন, উপনির্বাচন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন, প্রশাসন ও বিরোধীদের দমন-নিপীড়ন ইত্যাদিতে যে অভিজ্ঞতা তৈরি করেছিল তা বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় সৃষ্টি করেছিল। এরপর তৃতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন গঠন এবং এগুলোর ভূমিকা নিয়ে দেশে বড় ধরনের বিক্ষোভ-বিদ্রোহ তৈরি হয়। নির্বাচনই অনেকটা নির্বাসনে চলে যায়। দেশে ব্যাপক বিদ্রোহ সৃষ্টি হয়। এর ফলে ১/১১ এর স্বঘোষিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। তবে নতুন নির্বাচন কমিশন দেশের ভবিষ্যৎ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য এনআইডি, ভোটার তালিকা, আরপিওসহ নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়, যা সুষ্ঠু নির্বাচনের বেশ কিছু শর্ত পূরণ করে। স্বঘোষিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার কোনো বিকল্প দেখছিল না, তখন নির্বাচন কমিশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার পক্ষেই অবস্থান নেয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনটি এযাবৎকালের সবচেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের তালিকায় স্থান করে নিতে সক্ষম হয়। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি শুরু থেকেই নড়বড়ে, দুর্বল এবং রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বিপদে ফেলে দেওয়ার এক ঝুঁকিপূর্ণ অভিজ্ঞতার কথা শেখায়। একসময় এই ব্যবস্থা নিয়ে বড় বড় কথা বলা হলেও সেটি দ্রুতই ফিকে হয়ে যায়।

দেশের সর্বোচ্চ আদালত এই ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক উল্লেখ করে রায় দেওয়ার পর সংবিধান থেকে ব্যবস্থাটি তুলে দেওয়া হয়। বিরোধী দল পরবর্তী নির্বাচন বর্জন এবং প্রতিহত করার জন্য জ্বালাও-পোড়াও নীতি অনুসরণ করে।

২০১৮ সালে বিরোধীরা নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে কোনো আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে পারেনি। কারণ তারা নিজেরাই তখন বিভক্ত, অসংগঠিত ও দুর্বল অবস্থায় ছিল। জনগণের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকলেও দেশে অর্থনৈতিক নানা পরিবর্তনের কারণে মনোযোগটি রাজনীতি থেকে সরে যায়। তবে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা উবে যায়নি।

সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে এবার বেশ কিছু বাস্তবতা বিরাজ করছে। প্রথমত, নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিকভাবে আগের চেয়ে আইনের দিক থেকে বেশি শক্তিশালী; দ্বিতীয়ত, দেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এবার সংহত অবস্থানে আছে; তৃতীয়ত, সরকার থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি আছে এবং চতুর্থত, দেশি-বিদেশি সব মহলই বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক এমনটি প্রত্যাশা করছে, পর্যবেক্ষণ করতেও রাজি আছে। ফলে এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন প্রতিহত করা, প্রশ্নবিদ্ধ করা কিংবা হস্তক্ষেপ করার পরিবেশ এবার না দেখার সুযোগ অনেক বেশি। তবে এ ক্ষেত্রে যেটি অংশীজনদের করতে হবে, তা হলো কোনো পক্ষই নির্বাচনকে ক্ষতিগ্রস্ত করার কোনো ভূমিকা নেবে না এমন অবস্থান এখনই স্পষ্ট করে দিতে হবে। যদি বিরোধীপক্ষ প্রশ্নবিদ্ধ কিংবা প্রতিহত করার চেষ্টা করে, তাহলে তাদের অবস্থান বিদেশি বন্ধুদের অজানা থাকবে না, একইভাবে সরকারপক্ষ যদি নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে সেটিও কারো অদেখা-অজানা থাকবে না। তখন বিরোধীপক্ষ ১৯৯৬ সালের মতো আন্দোলন করলে কারো কোনো আপত্তি থাকবে বলে মনে হয় না। কিন্তু নির্বাচনের আগেই দেশে নির্বাচনকে ভণ্ডুল করা কিংবা প্রশ্নবিদ্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হলে তাতে দলীয় সমর্থকরাই অংশ নিতে পারে, সাধারণ ভোটার ও জনগণ তাতে অংশ নেওয়ার কোনো কারণ নেই।

এমন বাস্তবতায় সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের খুব কাছাকাছি আমরা অবস্থান করছি। নির্বাচনের মাঠে এবার সরকারের রাজনৈতিক দল ও জোট যেমন সংঘবদ্ধ আছে, বিরোধীরাও একাট্টা আছে। ফলে নির্বাচন কমিশনের রেফারির ভূমিকায় সর্বোচ্চ প্রস্তুতি আগে থেকেই নেওয়া থাকলে নির্বাচনটিকে কেউ বিতর্কিত ও হস্তক্ষেপ করে পার পাবে বলে মনে হয় না, সুষ্ঠু নির্বাচন জাতিকে উপহার দেওয়া সম্ভব হবে। এমন বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে পুরনো ব্যর্থ অভিজ্ঞতার কাছে ফিরে যাওয়ার চেষ্টাটি রাজনৈতিকভাবে চরম বিপর্যয় সৃষ্টি করা ছাড়া নতুন কোনো কিছু উপহার দেবে না। কারণ এখন যাঁরা তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো সমাধান দেখেন না, তাঁরা তো নিকট অতীতের তত্ত্বাবধায়কের অভিজ্ঞতা থেকেই শিক্ষা নিতে পারেন। সেই শিক্ষাটি তো সুখের নয়। ফলে জোর করে সেই ব্যর্থ অভিজ্ঞতায় ফিরলেই যে সেটি বেশিদিন কার্যকর থাকবে, বাতিল করতে হবে না—এমন কোনো গ্যারান্টি একেবারেই নেই।

রাজনীতিতে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যেক বাস্তব ও তীক্ষ দৃষ্টি দিয়ে দেখতে হয়, নতুবা বিপর্যয়ের পর বিপর্যয়ই ফিরে আসে। ৫২ বছর আমরা সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বপ্ন দেখেছি। যাঁরা এখন সুষ্ঠু নির্বাচন এবং গণতন্ত্রকে একাকার করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় ফিরে যেতে চান, তাঁদের হাতেই তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, নির্বাচনটিই তো অনুষ্ঠিত করতে পারেনি।

অনেকের মতে, ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচন প্রতিহত না করে অংশগ্রহণ করলে ফল অন্যরকম হতে পারত। জাতীয় নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফল যে ধারণা দেয় তাতে বিরোধী দলের নির্বাচন প্রতিহত করতে নেমে অগ্নিসন্ত্রাস করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। ২০১৮ সালে তাদের নিজেদের দুর্বলতা কতটা ছিল তা দেখে নেওয়াই ভালো। ড. কামাল হোসেনকে ইমাম ধরতে যাওয়ার মধ্যেই সেই দুর্বলতা পরিষ্কার। বিরোধীপক্ষের অসংগঠিত অবস্থাটি কেন তারা বিবেচনায় আনে না? নির্বাচনটি সরকার ও নির্বাচন কমিশন সচেতনভাবে সুষ্ঠু করার অবস্থানে অনড় ছিল।

এখন যেহেতু দুই পক্ষই পক্তপোক্তভাবে নির্বাচন করার অবস্থানে আছে, নির্বাচন কমিশনও যেহেতু শক্তিশালী একটি অবস্থানে আছে; তাই নির্বাচনে জয়-পরাজয় জনগণের ভোটের ওপরই নির্ভর করবে। ভোটদানে বাধা, কারচুপি, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার চেষ্টা ডিজিটাল এই যুগে গোপন কিংবা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। সুতরাং গণতন্ত্র, শাসনতন্ত্র এবং নির্বাচনের সর্বজনীন পথ যেখানে অনেকটা অভিজ্ঞতা থেকে একটি সুষ্ঠু জায়গায় নেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেখানে দেশে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করার পথ যারা তৈরি করবে, তারাই শুধু রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, দেশকেও বিপদের মুখে ফেলে দেবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্যতম শর্তই হচ্ছে সব পক্ষের অপরিহার্য অংশগ্রহণ।

লেখক : ইউজিসি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফেলো ও সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন