দীর্ঘ সাড়ে চার বছর পর আজ (বুধবার) রংপুর যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাড়ে ৩ ঘণ্টার সফরে প্রধানমন্ত্রী রংপুর সার্কিট হাউসে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়, বিভিন্ন প্রকল্পের উদ্বোধনসহ রংপুর জিলা স্কুল মাঠে বিভাগীয় জনসমাবেশে যোগ দেবেন। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বলছেন, এটিই হবে রংপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্মরণকালের সর্ববৃহৎ সমাবেশ। এর আগে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে রংপুর এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার স্বামী প্রয়াত পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম ওয়াজেদ মিয়ার গ্রামের বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জে। সে হিসেবে রংপুরবাসীর পুত্রবধূ তিনি। তাই বধূবরণে আয়োজনের বিন্দুমাত্র কমতি নেই কোথাও। উজ্জ্বীবিত আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা। প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে নেতাকর্মীদের মধ্যে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের ঢেউ বইছে। মিছিলে মিছিলে একাকার নগরী। চলছে বর্ণিল-বর্ণাঢ্য প্রচারণা। প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়ে পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ডে ছেয়ে গেছে পুরো নগরী। নগরীর বৈদ্যুতিক পিলার, ল্যাম্প পোস্ট, দেয়াল, গাছ কোথাও ফাঁকা নেই। ধুয়ে মুছে চকচকা করা হয়েছে রাস্তাঘাট, রোড ডিভাইডার। চলছে বাদ্যযন্ত্র ও গানের তালে নেচে গেয়ে মাইকিং। জনসভা স্থল ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংক মোড়, জিলা স্কুল মোড়, ডাকঘর মোড়, সুরভি উদ্যান মোড়, পুলিশ লাইন্স মোড়, সিটি বাজারসহ বিভিন্ন পয়েন্টে মাইক সাটানো হয়েছে। একের পর এক কেন্দ্রীয় নেতারা আসছেন। শেষমুহূর্তে মাঠ পরিদর্শনসহ বিভিন্ন প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন তারা।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে ঘিরে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে রংপুর মহানগরী। চলছে শেষ মুহূর্তের মাঠ, মঞ্চ সাজানোর কাজ। রংপুর মহানগরীর ২১টি পয়েন্টে করা হয়েছে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। এক হাজারের বেশি সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। প্রবেশ রুট গুলোতে সন্দেহভাজন যানবাহন ও ব্যক্তিদের তল্লাশি করা হচ্ছে। সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে জনসভায় আসা-যাওয়া নির্বিঘ্ন করতে চায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। জিলা স্কুল মাঠে এসএসএফসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা কাজ করছেন সর্বোচ্চ সতর্কতায়। মাঠের দক্ষিণ পশ্চিম কোণায় নৌকার আদলে তৈরি করা হয়েছে সভামঞ্চ। পাশেই মিডিয়া, মুক্তিযোদ্ধা ও অতিথি কর্নার। সামনে থাকবে জনতা। প্রস্তুতির কাজ তদারকি করছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। প্রতিদিন মাঠ-মঞ্চসহ সার্বিক পরিস্থিতি পরিদর্শন করছেন তারা। জিলা স্কুল মাঠের জনসভায় থেকেই নির্বাচনি প্রচারণা শুরু করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এমনটা জানিয়েছেন নেতারা।
রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ও স্বেচ্ছাসেবক উপকমিটির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, আমরা ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছি। পাড়া-মহল্লায় উঠান বৈঠক থেকে শুরু করে সভা সমাবেশ করা হয়েছে। গ্রামেগঞ্জে শহরে বন্দরে খণ্ড খণ্ড মিছিল করা হয়েছে। পুরো বিভাগজুড়ে ব্যাপক গণসংযোগ চালানো হয়েছে। বিগত সময়ের উন্নয়নগুলো তুলে ধরা হচ্ছে। মানুষ এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ঘিরে উচ্ছ্বসিত। তারা জনসভায় যোগ দিতে অপেক্ষা করছে।
রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের আহবায়ক কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট আতিক-উল-ইসলাম কল্লোল বলেন, আমরা খুব আনন্দিত, উদ্বেলিত। আমরা সবাই বঙ্গবন্ধুকন্যা রংপুরের পুত্রবধূ শেখ হাসিনার আগমনে উচ্ছ্বাসে একাকার হয়ে গেছি। আমরা তাকে নবসাজে বরণ করতে সবধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। আমরা আশা করছি, লাখ লাখ মানুষের ভিড়ে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা স্বাগত জানাতে জিলা স্কুল মাঠে পুরুষের পাশাপাশি নারীর ব্যাপক সমাগম ঘটবে। যা রংপুরের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আওয়ামী লীগের রংপুর বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর জনসভাকে ঘিরে রংপুরসহ পুরো বিভাগে উৎসবের আমেজ চলছে। প্রধানমন্ত্রী যেহেতু বঙ্গবন্ধুকন্যা তার ক্যারিশমাটির নেতৃত্বের কারণে দলমত নির্বিশেষে লোকে লোকারণ হয়ে যাবে। গোটা শহর মানুষে মানুষে টইটম্বুর হয়ে যাবে।
দলের প্রেসিডয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জনসভার সব আয়োজন ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। এই জনসভায় প্রায় ১০ লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটবে। পুরো রংপুর এই জনসভা ঘিরে জয়বাংলার জনস্রোতে রূপান্তরিত হবে। পুরো বিভাগজুড়ে যেভাবে দলীয় নেতাকর্মীরা প্রচার-প্রচারণা ও গণসংযোগ চালিয়েছে, তাতে আমরা মনে করি রংপুরের মানুষের জন্য এটি হবে ঐতিহাসিক জনসভা। তিনি বলেন, ইনশাআল্লাহ এই জনসভা থেকেই নির্বাচনি প্রচারণা শুরু করবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা।
রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (অপরাধ) আবু মারুফ হোসেন জানান, জনসভাকে ঘিরে সব ধরণের নিরাপত্বার বন্দোবস্ত করেছি আমরা। পোশাকী পুলিশের পাশাপাশি আর্মডসহ সাদা পোশাকে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য থাকবে। জনসভাস্থল ছাড়াও থাকবে পথে পথে রুট ডিউটি, থাকবে চেকপোস্ট, পুরো নগরীর গুরুত্বপূর্ন প্রবেশ পথ ও মোড়ে মোড়ে থাকবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। উঁচু ভবনের ছাদে এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর প্রতি ফ্লোরে ফ্লোরে থাকবে প্রশিক্ষিত আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা।
আবু মারুফ হোসেন বলেন, জনসভাস্থল, পুরো শহর এবং সার্কিট হাউজ পুরোটাই আমরা সিসিটিভির কাভারেজে এনেছি। ১ হাজারেরও বেশি সিসিটিভি ক্যামেরা সিটি করপোরেশনের সহযোগিতায় আমরা বসিয়েছি। এটা আমরা ডিজিটালি মনিটরিং করবো। পর্যাপ্ত সংখ্যক আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য মাঠে এবং পুরো নগরীজুড়ে থাকবেন। সাথে থাকবেন আয়োজকদের স্বেচ্ছাসেবককরা। যাতে জনগন মাঠে সুশৃংখলভাবে আসতে পারেন, সুন্দর পরিবেশে সভা শুনতে পারেন।
২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়ের মধ্য দিয়ে বদলে যেতে থাকে রংপুর। বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা ও সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য রংপুর এখন উত্তরাঞ্চলের রাজধানী। শেখ হাসিনার আমলে রংপুর বিভাগ, সিটি করপোরেশন, মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এ বছরের ১৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী রংপুর বিভাগীয় সদরদপ্তরের উদ্বোধন করেছেন। এছাড়া রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয়, মেরিন একাডেমি, উপজেলাগুলোতে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপন, তিস্তা সড়ক সেতু নির্মাণসহ নানা উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন হয়েছে। এলেঙ্গা-রংপুর ছয়লেন মহাসড়কের কাজ চলমান। পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহের কাজও শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক প্রকল্পের সুফল ভোগ করছেন রংপুরবাসীরা। এক সময়ের ‘মঙ্গাপীড়িত’ রংপুর এখন উন্নয়নের মোড়কে বদলে গেছে অনেকখানি। এবারের জনসভাতেও দুই ডজনের বেশি উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর রংপুর সফরকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন তিস্তাবেষ্টিত এই অঞ্চলের মানুষ। কারণ প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিস্তাপাড়ের মানুষের ভাগ্যবদলে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের। তাদের আশা প্রধানমন্ত্রী এবারের রংপুরের জনসভায় বহু আকাঙ্ক্ষিত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে কোনো সুখবর নিশ্চয়ই দেবেন। কারণ, পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ায় তিস্তা এখন উত্তরের মানুষের দুঃখ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছর বন্যা এবং খরায় নদীপাড়ের মানুষের দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। তিস্তার দুই পাড়ের লাখ লাখ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করতে পারে একমাত্র মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হলে তিস্তাপাড়ের মানুষের পানির জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না।
রংপুর জেলার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২ আগস্ট রংপুর জেলা সফর করবেন। তিনি রংপুর জিলা স্কুল মাঠে বিশাল জনসভা থেকে প্রায় ১২৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৭টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও পাঁচটি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে ১৭ তলাবিশিষ্ট ক্যানাসার হাসপাতাল নির্মাণ, র্যাব-১৩ ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি অবকাঠামো।