একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ-রাষ্ট্র বিনির্মাণের ভিত্তি হলো মানসম্পন্ন শিক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত ও কার্যকর জ্ঞান অর্জন করা। যারা যত বেশি প্রায়োগিক জ্ঞান অর্জন করতে পারবে, তারাই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকার যোগ্যতা অর্জনে সক্ষম হবে। ফলে বিশ্বের দেশে দেশে উচ্চশিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সক্ষমতা ও মানোন্নয়নে জোর দেওয়া হচ্ছে, যার প্রকৃষ্ট নিয়ামক হলো ওয়ার্ল্ড র্যাংকিং পদ্ধতি, যেখানে প্রধান সাতটি ক্ষেত্র বিবেচনায় নেওয়া হয়। এগুলো হলো : প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, প্রযুক্তিগত ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ, উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, উন্নয়ন ও উদ্ভাবন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও সহায়ক পরিবেশ। এই অবস্থায় সেখানে বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে বরাবরই ভালো করছে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো। এবারও শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে সুইজারল্যান্ড, দ্বিতীয় অবস্থানে সুইডেন, তৃতীয় অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র। প্রথম পাঁচে আছে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান আরো দুটি দেশ—ফিনল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস। এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো করেছে সিঙ্গাপুর, যেখানে দেশটির বৈশ্বিক অবস্থান ষষ্ঠ, ভালো অবস্থানে আছে ইসরাইল, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও চীন। মূলত প্রশিক্ষণ ও গবেষণার পর্যাপ্ত সুবিধা, মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান, অত্যাধুনিক উত্পাদন প্রক্রিয়া, যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা, দক্ষ ব্যবস্থাপনা আর সুশাসিত ও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা দেশগুলোকে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রেখেছে, যা তাদের সাফল্যের মুখ্য বিষয়।
‘টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং’ ২০২৩-এ বিশ্বসেরা ১ হাজার ৭৯৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ পায়। এই তালিকায় বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম সেরা ৫০০-এর মধ্যে নেই। বাংলাদেশের যে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিংয়ে স্থান পেয়েছে, সেগুলো হচ্ছে : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। র্যাংকিংয়ে আগের মতো এবারও বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান শেষের দিকে। বিশ্বব্যাপী এ তালিকায় ৬০১ থেকে ৮০০ তমের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে। র্যাংকিংয়ে ৫০০-এর মধ্যে থাকলে আন্তর্জাতিক গুরুত্ব বাড়ে। কারণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উচ্চশিক্ষায় ঐ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সুনির্দিষ্ট অবদান প্রকাশ করে টাইমস হায়ার এডুকেশন ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং। বাংলাদেশ থেকে এই র্যাংকিংয়ে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ৫০০-এর মধ্যে স্থান না পেলেও প্রতিবেশী ভারতের পাঁচটি এবং পাকিস্তানের একটি বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বসেরা ৫০০-এর তালিকায় রয়েছে। এছাড়া শীর্ষ ২০০-এর মধ্যে ১১টি প্রতিষ্ঠান নিয়ে চীন চতুর্থ অবস্থানে আছে।
কেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান সেরা ৫০০-তে নেই—এসব প্রশ্ন নিয়ে গভীরভাবে পরিকল্পনা করা এবং দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়া আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে। এই র্যাংকিংয়ে যেসব সূচক বিবেচনা করা হয়, তার মধ্যে একাডেমিক খ্যাতি ও গবেষণা (৬০ শতাংশ স্কোর) সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। সূচকের মধ্যে শিক্ষা ও গবেষণার মান বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক খ্যাতি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন র্যাংকিংয়ে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিছিয়ে আছে। এটিকে নেতিবাচক হিসেবে দেখার আগে কিছু বিষয় পর্যালোচনা করা দরকার। এই র্যাংকিং যে ধারা বা ক্রাইটেরিয়া অনুযায়ী করা হয়, আমাদের রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সেই ধারা এখনো পরিপূর্ণ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সেভাবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জ্ঞানচর্চার সুযোগ দেওয়া যাচ্ছে না। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক, বহির্বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষা নিয়ে কাজের সুযোগ সৃষ্টি—এসব বিষয়ে বাংলাদেশ যে মানের দেশ, সেই জায়গা থেকে আমরা যদি এখনই মনে করি র্যাংকিংয়ে ৫০০ বা ২০০-এর মধ্যে প্রবেশ করব, সেটি অবাস্তব প্রত্যাশা হবে। আমাদের রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রেক্ষাপট এখনো সেই জায়গায় নেই। অক্সফোর্ড, ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (ক্যালটেক) অথবা স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র্যাংকিংগুলোর শীর্ষে অবস্থান করছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে সুযোগ-সুবিধা পায় বা তাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে যে বরাদ্দ, পরিচালনাগত চৌকশ নীতি—এসব থেকে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছি। এই জায়গাগুলোয় আমাদের রাষ্ট্র যদি অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়, সবকিছুর ওপরে যখন শিক্ষা খাতকে স্থান দেওয়া হবে, তখন বিশ্ববিদ্যালয় তার স্থান আরো বেশি স্বচ্ছ জায়গায় নিয়ে যেতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয় এই কাজ যখন গুরুত্ব দিয়ে করবে, যেমন অ্যালামনাই যারা রয়েছেন তাদের সঙ্গে আরো বেশি কাজ করা, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে কাজ করা, শিক্ষার্থীরা কোন ধরনের জব মার্কেটে যাচ্ছে, কোন জায়গায় তারা কাজ করছে, এক্ষেত্রে যদি আমরা কারিকুলাম নির্ণয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিশ্চিত করতে পারি, তখন র্যাংকিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান আরো বেশি উঠে আসবে।
বর্তমানে জ্ঞান সূচকে বিবেচ্য সব চলকেই বাংলাদেশের নৈপুণ্য কম সন্তোষজনক। শুধু তাই নয়, বৈশ্বিক প্রতিভা সূচক ও বৈশ্বিক উদ্ভাবন সূচকেও একই পরিস্থিতি বিদ্যমান বলে প্রতীয়মান হয়। ফ্রান্সভিত্তিক বিজনেস স্কুল ইন সিয়েড এবং ওয়াশিংটনভিত্তিক পোর্টুল্যান্স ইনস্টিটিউটের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিভা সূচকে ১৩৪ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৩ নম্বরে। একইভাবে জাতিসংঘের সংস্থা ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন প্রকাশিত সর্বশেষ বৈশ্বিক উদ্ভাবন সূচকে ১৩২ দেশের মধ্যে আমাদের অস্থান ১১৬ নম্বরে। সবচেয়ে হতাশাজনক হলো, এ দুটো সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় সবার নিচে বাংলাদেশ। এসব তথ্য স্পষ্টত বৈশ্বিক জ্ঞান পরিমণ্ডলে দেশের দৈন্যদশাই তুলে ধরে।
গত কয়েক বছর উচ্চশিক্ষায় অনেক উন্নয়ন হলেও গবেষণা তেমন কোনো গুরুত্ব পায়নি। গবেষণা খাতে আমাদের আর্থিক বরাদ্দ যথেষ্ট না থাকলেও গবেষণা হয়, কিন্তু সেটা আন্তর্জাতিক মানে জায়গা করে নেওয়ার মতো যথেষ্ট নয়। এখন আসা যাক গবেষণা খাতে বাজেট বরাদ্দের কথায়। বিশ্বের যেসব দেশে জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে কম বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার মধ্যে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে এই খাতে বাংলাদেশের ব্যয় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও সর্বনিম্ন, যেখানে প্রতিবেশী নেপাল, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, মালদ্বীপ এবং আফগানিস্তানও শিক্ষা খাতে আরো বেশি অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গত অর্থবছরের বাজেট পাশ হয়েছে ৯২২ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। বাজেটে গবেষণা খাতে করা হয়েছে ১৫ কোটি ৫ লাখ টাকা, যা মোট বাজেটের ১ দশমিক ৬৩ শতাংশ; যা খুবই নগণ্য। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট বাজেটের ১ বা ২ শতাংশ গবেষণা খাতে বরাদ্দ করলে গবেষণা কীভাবে হবে? গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গত অর্থবছরে দেশের ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ১০ হাজার ৪৪৪ কোটি ৪ লাখ টাকা, যা থেকে গবেষণার জন্য মূল বাজেটে ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ৪৭তম বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২০ সালে ঢাবি গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা করে ২৩৩টি। ঠিক এই সময়ে সর্বোচ্চ গবেষণা প্রকল্প (৮২১টি) পরিচালনা করেছে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় একই সালে গবেষণার পেছনে ব্যয় করেছে ৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় খরচ করে ৪ কোটি টাকা। সে বছর বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই খাতে ব্যয় ছিল ৩ কোটি টাকার বেশি। ইউজিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা করে (৪৬৪টি) বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১৩টি এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত হয় ১৪৩টি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, গবেষণার কাজে বাংলাদেশের ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয় ১ টাকাও খরচ করেনি। এর মধ্যে আছে আটটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও। সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের যুক্তি, বিষয়টি বাধ্যতামূলক নয়, কিন্তু ইউজিসি বলছে, এ ব্যাপারে একটা বাধ্যবাধকতা আছে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মৌলিক গবেষণা থাকতে হবে।
বাংলাদেশ শুধু একটা উন্নয়নশীল দেশ নয়, এর অর্থনীতি বিশ্বের সবচেয়ে গতিশীল অর্থনীতিগুলোর একটি; স্বল্প সময়ের মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচন করে ২০৪১ সালের মধ্যে একটা উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া তার লক্ষ্য। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে যে উন্নত জ্ঞান, প্রযুক্তি, সর্বোপরি জনবল প্রয়োজন, তার জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় প্রচুর নিজস্ব গবেষণা দরকার। বলা বাহুল্য, বিশেষজ্ঞদের মতে, ঐ জ্ঞান-প্রযুক্তি ও জনবল সৃষ্টি করতে পারলে বাংলাদেশ তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকা হবে অগ্রগণ্য।
লেখক : অধ্যাপক, ডিন ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা