কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অকৃত্রিম সংকট

রাজীব সরকার

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। প্রতীকী ছবি

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জনপ্রিয় সংস্করণ চ্যাটজিপিটি এক অঘটনঘটনপটীয়সী প্রতিভার নাম। আদেশ করামাত্র আলাদিনের চেরাগের দৈত্যের মতো কাঙ্ক্ষিত বস্তু এনে দিচ্ছে। ক্লাসের অ্যাসাইনমেন্ট, গবেষণাপত্র, অভিসন্দর্ভ তার আয়ত্তের মধ্যে। এমনকি গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও প্রবন্ধ লেখার দিকেও হাত বাড়িয়েছে চ্যাটজিপিটি। লেখকের কল্পনা প্রতিভা কিংবা লিপিকুশলতার আর প্রয়োজন হবে না। যান্ত্রিক উপায়ে কৃত্রিম সাহিত্যে সয়লাব হয়ে যাবে দেশ।

বিপদ শুধু সাহিত্যের দিক থেকে নয়; শিল্প-সংস্কৃতির অন্যান্য দিক থেকেও রয়েছে। হলিউডে অভিনয়ের ক্ষেত্রে প্রবল শঙ্কা তৈরি করেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার। যে কোনো অভিনেতার মুখচ্ছবি কিনে নিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে চরিত্র নির্মাণ করছে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম কিংবা প্রযোজনা সংস্থা। অর্থাৎ যে কোনো অভিনেতা- অভিনেত্রীর মুখের ছবি একবার ধারণ করার পর সেই অভিনয়শিল্পীকে আর প্রয়োজন হচ্ছে না। তাঁর হাসি, কান্না, প্রেম– সবকিছুই নির্মাণ করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এর আগে হলিউডের চিত্রনাট্যকাররা ধর্মঘট ডেকেছিলেন একই কারণে। এই প্রযুক্তির অপব্যবহারের আরেকটি দিক হচ্ছে, নায়ক-নায়িকারা বয়স্ক হয়ে গেলেও তাদের যৌবনের ছবি দিয়ে চরিত্র নির্মাণ সম্ভব। এমনকি মৃত অভিনয়শিল্পীদেরও ফিরিয়ে আনা সম্ভব। মারলোন ব্র্যান্ডো, আলা পাচিনো, সোফিয়া লরেন, অড্রে হেপবার্ন, মেরিলিন মনরো ফিরে এসেছেন পর্দায় এ যুগের চরিত্র হয়ে– ভাবা যায়!

যন্ত্র যদি মানুষের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে, তখন দানবের কাছে মানব পরাজিত হয়। এর ইঙ্গিত ‘মুক্তধারা’ নাটকে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। নানা দেশের সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে যন্ত্রের ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে ওঠার বিপদের দৃষ্টান্ত রয়েছে। এর পরও মানুষ সচেতন হচ্ছে না। এর মূল কারণ সস্তা সাফল্যের লোভ, যা পুঁজিবাদী সভ্যতার আগ্রাসী চেহারাকে তুলে ধরে। এতে শুধু ব্যক্তির প্রতিভা, মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্বই বিনষ্ট হচ্ছে না; লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এক অপরিহার্য বাস্তবতা। এই প্রযুক্তির ইতিবাচক দিক রয়েছে। এর সঙ্গে মানিয়ে চলতে না পারলে পিছিয়ে পড়তে হবে। কিন্তু এর কাছে আত্মসমর্পণের বিপদ আরও বেশি। রজনীকান্ত অভিনীত আলোচিত ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘রোবট’-এর কথা নিশ্চয় সবার মনে আছে। বিনোদন ও অ্যাকশননির্ভর এ চলচ্চিত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার নিয়ে একটি শিক্ষণীয় বার্তা রয়েছে। সৃষ্টি যদি তার স্রষ্টার চেয়ে শক্তিমান হয়ে ওঠে, তাহলে ভয়ংকর বিপর্যয় নেমে আসে। যন্ত্রের প্রয়োজনীয় ব্যবহার মানবকল্যাণ সাধন করে। যন্ত্রের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানুষকে যন্ত্রের দাস করে তোলে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নির্ভেজাল আশীর্বাদ হিসেবে বিবেচনা করা ভুল হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজে কৃত্রিম হতে পারে, কিন্তু এর তৈরি সংকট কৃত্রিম নয়। অন্য প্রাণীর চেয়ে মানুষ স্বতন্ত্র ও অগ্রসর তার হৃদয়বৃত্তির কারণে। হৃদয়বৃত্তিকে অস্বীকার করে শুষ্ক বুদ্ধিমত্তার জোরে সাময়িক সাফল্য আসতে পারে। এর জন্য মূল্য দিতে হবে অনেক বেশি। মেধা ও সৃজনশীলতা মানুষের অনন্য সম্পদ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গুরুত্ব এই অনন্য সম্পদের চেয়ে বেশি হওয়া চরম অশনিসংকেতের লক্ষণ। এই অকৃত্রিম সংকটের ঝুঁকি মাথায় রেখে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারে সজাগ দৃষ্টি প্রয়োজন।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

শেয়ার করুন