কাশ্মীর: উন্নয়ন যেখানে মন জয়ের অস্ত্র

মহসীন হাবিব

কোনো কোনো সিদ্ধান্ত, কখনো কখনো আপাতদৃষ্টিতে নেতিবাচক মনে হলেও পরবর্তী ফলাফলই প্রমাণ করে সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল কি না। এজন্য ধারণার ওপর নির্ভর করতে নেই। সিদ্ধান্তের ফলাফলই প্রমাণ। আজ থেকে চার বছর আগে, ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারত সরকার সংবিধানে কাশ্মীরের স্পেশাল স্ট্যটাস ৩৭০ যখন বাতিল করেছিল, তা নিয়ে দেশটিকে দেশে-বিদেশে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল।

কিন্তু গত চার বছরে জম্মু ও কাশ্মীরের যে ইতবাচক পরিবর্তন হয়েছে তা বিস্ময়কর, অভাবনীয় এবং দেখার মতো। কোনো মত বা পথের দিকে নয়, পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই সেটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।

universel cardiac hospital

উল্লেখ্য, একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশের জনগণ যাতে নির্দ্বিধায় হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে নিরাপদে এবং নিজেদের মতো করে স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করতে পারে, সেই লক্ষ্যেই ১৯৪৯ সালে সংবিধানে ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রবর্তন করা হয়েছিল। কিন্তু তা সফল হয়নি। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কাশ্মীরকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছিল নিজস্ব সংবিধান প্রণয়নের। এছাড়া জম্মু কাশ্মীরকে আরও একটি সুবিধা দেওয়া হয় ৩৫/এ ধারায়। এ ধারা অনুযায়ী কাশ্মীরে স্থায়ী বসবাসের ব্যাপারে রাজ্যের আইন প্রণেতাদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়।

দুর্ভাগ্যক্রমে দেখা গেছে, কাশ্মীর যারাই শাসন করেছেন, বিশেষ করে ৮০র দশক থেকে পাকিস্তানের মদতে কাশ্মীরে হত্যাকাণ্ড, সন্ত্রাস সৃষ্টিকে মদত দিয়েছেন। ফলে কাশ্মীর হয়ে উঠেছিল অগ্নিকুণ্ডের মতো। এইসব সন্ত্রাসী হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে, কাশ্মীরের অর্থনীতিকে চরমভাবে বিপন্ন করেছে, যা ২০১৯ সাল পর্যন্ত চলমান ছিল। ভারত সরকারকে বেশিরভাগ সময় অসহায়ের মতো সেইসব তাণ্ডব দেখতে হয়েছে। কিন্তু ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ৩৭০ অনুচ্ছেদ তুলে দেওয়ার পর থেকে বলতে গেলে রাতারাতি কাশ্মীরে অমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। যেমন ২০১৬ থেকে ২০১৯ সালের আগস্ট পর্যন্ত পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ১২৪ জন নিহত হয়। কিন্তু গত চার বছরে কাশ্মীরের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে একটিও বড় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। ২০১৯ সালের পর থেকে নাটকীয়ভাবে সন্ত্রাসী আক্রমণ কমে গেছে নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোর নজরদারিতে। ক্রমাগত কমে আসছে সন্ত্রাসী হামলার চেষ্টা। ২০২৩ সালে এ পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনীর অ্যানকাউন্টারে ৩৫ জন জঙ্গি নিহত হয়েছে। কিন্তু গত বছর এ সংখ্যা ছিল ১৮৬ জন। এর মধ্যে ৫৬ জন ছিল বাহির থেকে আসা, অর্থাৎ অধিকাংশই পাকিস্তানি বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্য। কাশ্মীরে অনুপ্রবেশের চেষ্টাও প্রতিহত হয়েছে বেশ কয়েকটি।

এ নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ায় কাশ্মীরে নানা অনুষ্ঠান আয়োজন সম্ভবপর হয়ে উঠেছে। গত ৩ আগস্ট সোপিয়ান জেলায় সাউথ এশিয়া সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড পিপল’স এমপাওয়ারমেন্টের আয়োজনে সোপিয়ান সরকারি ডিগ্রি কলেজে বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। যেখানে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, একাডেমিক, সাংবাদিক থেকে শুরু করে সমাজের নানা পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন। কাশ্মীরের উন্নতির একটি বড় সাক্ষী বিনীয়োগ। ১৯৪৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময়ে কাশ্মীরে বিনীয়োগের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৪ হাজার রুপি। সেখানে গত চার বছরে নতুন শিল্প উন্নয়ন স্কিমে ৮২ হাজার কোটি রুপি বিনীয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। গত বছর কাশ্মীরে ১ কোটি ৮৮ লাখ ট্যুরিস্ট সফল করেছে। এবছর আরও সংখ্যা বাড়বে বলে কর্তৃপক্ষের ধারণা। ভারত স্বাধীনের পর থেকে এত ট্যুরিস্ট কখনোই কাশ্মীরে প্রবেশ করেনি। কাশ্মীরে ভ্রমণের প্রতি যে একটি ভয় আতঙ্ক কাজ করতো, তা এখন সম্পূর্ণ সরে গেছে। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্যুর অপারেটর অব কাশ্মীরের তথ্যমতে বিগত চার বছরে বাংলাদেশি ট্যুরিস্টের সংখ্যা বেড়েছে ৫ গুণ। সেসব গ্রামের মানুষ কখনো বিদ্যুতের বাতি দেখেনি, সেইসব এলাকায় এখন রাতেও আলোর নিচে ট্যুরিস্ট ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। কাশ্মীরের মানুষের অর্থনৈতিক শক্তি বাড়ছে হু হু করে। অবাক করা তথ্য হলেও সত্যি বাংলাদেশে এখন ৭ থেকে ৮ হাজার কাশ্মীরি শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে।

কাশ্মীরকে বলা হয় ভূস্বর্গ। কিন্তু এই ভূস্বর্গকে সন্ত্রাসীরা নরকে পরিণত করেছিল। পাকিস্তানের মদতপুষ্ট অবৈধ টিম্বার ব্যবসায়ীরা লাখ লাখ গাছ কেটে কাশ্মীরের প্রকৃতি বৈরী করে তুলেছিল। কিন্তু লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহা ইউনিয়ন টেরিটরিতে বৃক্ষরোপণের জন্য ‘গ্রিন জম্মু কাশ্মীর ড্রাইভ-২০২১’ প্রকল্প হতে নিয়েছেন। এই প্রকল্পের অধীনে ২০২২-২৩ সালে ১৫ কোটি চারা রোপণের পরিকল্পনা করা হয়েছে।

অবকাঠামো উন্নয়নের দিক দিয়ে হাইওয়ে, রেলওয়ে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে কাশ্মীরের বিশেষ করে অবকাঠামোর দিকে বিবেচনায় ২২ বিলিয়ন ডলার বরাদ্ধ করা হয়েছে। কাশ্মীরের জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তনের আরো একটি উদাহরণ হলো, প্রাইভেট কারের দিক দিয়ে কাশ্মীর এখন ভারতের তৃতীয় বৃহৎ রাজ্য। প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন প্যাকেজে ১৫টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৫৮,৪৭৭ কোটি রুপি ব্যয়ে ৫৩টি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও নারী উন্নয়নে, আত্ম-কর্মসংস্থানে নেওয়া হয়েছে ব্যাপক উদ্যোগ। কাশ্মীর সুফিসাধকদের অঞ্চল হিসাবে সুবিখ্যাত। কিন্তু সেই সুফি সাধকদের স্থান দখল করে নিয়েছিল সন্ত্রাস ও মৌলবাদী চক্র। কিন্তু ভারতের সরকার ৭৫টি সুফি ও ধর্মীয় স্থানকে নতুন করে উন্নয়ন সাধনের উদ্যোগ নিয়েছে।

আজ একটু ভালো করে চোখ মেললেই আমরা দেখতে পাবো, পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর এবং জম্মু ও কাশ্মীরের মধ্যে পার্থক্য। ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে লোকসংখ্যা প্রায় দেড় কোটি এবং পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে লোকসংখ্য ৫২ লাখ। ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৩৫টি, পক্ষান্তরে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে মাত্র ছয়টি। তাও আবার বিভিন্ন একাডেমিক রেকর্ড থেকে জানা যায়, জম্মু কাশ্মীরের তুলনায় পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের লেখাপড়ার মান অত্যন্ত নিম্নমানের।

শান্তিই জগতের মানুষের শেষ কথা, শেষ চাওয়া। সে শান্তি যেমন অর্থনৈতিক, তেমনি সামাজিক ও রাজনৈতিক। বিশ্বব্যাপী লক্ষ করা যায়, অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যই মানুষের মধ্যে শান্তি আনার অন্যতম বাহক।

ধর্মকে ব্যবহার করে, ধর্মের অপব্যাখ্যা করে যারা কাশ্মীরে শান্তি বিনষ্ট করার প্রয়াস পেয়েছে, তারাই সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল নিয়ে অধিক হৈ চৈ করেছে এবং এখনো করছে। গত মে মাসে কাশ্মীরে অনুষ্ঠিত হয়েছে জি২০ ট্যুরিস্ট সম্মেলন। বহির্বিশ্বের গণমাধ্যম সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগকে অত্যন্ত ইতিবাচক গ্রহণ করেছে। আমি গত মে মাসে কাশ্মীরে গিয়েছিলাম। আমার এক নিকট প্রতিবেশীও সম্প্রতি কাশ্মীর সফর করে এসেছেন। তিনি ফিরে এসে বললেন, ‘আগে তো কাশ্মীরের নাম শুনলেই পিলে চমকে উঠতো। কিন্তু গিয়ে দেখলাম, কাশ্মীর তো উপমহাদেশের অন্য অনেক জায়গার তুলনায় শান্ত ও নিরাপদ। মানুষের মধ্যেও তো একটা প্রশান্তির চেহারা বিরাজ করছে!’ আমারও সেখানে গিয়ে তাই মনে হয়েছে। দেখে শুনে মনে হয়েছে ভারত সরকার মনেপ্রাণে কাশ্মীরের উন্নয়ন করে বিশ্বের কাছে প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর যে, তারা কাশ্মীরের জনগণের উন্নয়ন ও ভারতের শান্তিতে বসবাসকে সমান দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে। তারা কাশ্মীরের জনগণের মন জয় করে প্রমাণ করতে চাচ্ছেন যে সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে তারা সন্ত্রাসবাদকে উচ্ছেদ করে জনগণের কল্যাণকেই প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর। কাশ্মীরে ভারত সরকার সফল হলে এই গোটা উপমহাদেশের শান্তিতেই তা বিশেষ অবদান রাখবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।

শেয়ার করুন