৫ আগস্ট শহীদ শেখ কামালের জন্মদিন। মাত্র ২৬ বছর বয়সে অমিত সম্ভাবনাময় এই যুবক শাহাদত বরণ করেন পিতা-মাতা ও ভাই-বধূসহ পরিবারের অন্যান্যের সঙ্গে সেনাবাহিনীর দলছুট ঘৃণ্য ঘাতকের বুলেটের আঘাতে। রাজনীতির রাজপথ, সংস্কৃতির অঙ্গনের নাটক, সেতার, সংগীতের মঞ্চ আর ফুটবল, ক্রিকেট, বাস্কেটবল—সর্বত্রই একই গুরুত্বে পদচারণা ছিল তার। ক্যারম, টেবিল টেনিস আর ব্যাডমিন্টনেও তার আগ্রহ ছিল অনেক। এমনই এক চৌকশ তরুণ যুবককে আমরা হারাই অকালে। আবাহনী ক্রীড়া চক্র আর স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী গঠনে তিনি ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা। নাট্যচক্রে এবং মঞ্চ নাটকের নানা কর্মে তার ছিল সহজগম্যতা।
শেখ কামাল জাতির পিতার সন্তান হিসেবেই যে পরিচিত ছিলেন তা নয়। তিনি তার বহুমাত্রিক কর্মক্ষেত্রে নিজস্ব পরিচিতিও গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। ২৫ মার্চ রাত্রে বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতারের সময়েই তিনি স্বগৃহ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। প্রথমে ওয়্যার কোর্সে অংশ নিয়েছিলেন। পরে মুক্তিবাহিনী প্রধান জেনারেল এম এ জি ওসমানী সাহেবের এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পরও তিনি সেনাবাহিনীতেই থেকে যান; কিন্তু আমরা যারা তার ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত নেতৃস্থানীয় ছাত্রলীগ কর্মী ছিলাম তাদের সঙ্গে যোগাযোগ থেকেই যায়। ইতিমধ্যে ছাত্রলীগ ভেঙে যায়। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের অতিবাম স্লোগান তুলে ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ অংশ মুজিবাদর্শের বাইরে চলে যায়। আমরা ‘মুজিববাদ’ স্লোগান নিয়ে মুজিবাদর্শের পতাকা হাতে পথ চলতে শুরু করি। ঢাকা শহর (বর্তমান অবিভক্ত মহানগর) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মীদের একটি বড় অংশ ছিল শেখ কামালের অনুসারী। ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজ ও কায়েদে আজম (বর্তমানে শহিদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) ছাত্র সংসদ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের ওপর তার প্রভাব ছিল অপরিসীম। এমতাবস্থায় আমরা কতিপয় বন্ধু মিলে কামাল ভাইকে ফিরিয়ে আনতে চাই ছাত্রলীগে। খালাম্মার সমর্থন নিয়ে আমরা কাজ করি এবং বঙ্গবন্ধুকে কনভিন্স করতে সক্ষম হই। কামাল ভাইয়ের সম্মতি ছিল শতভাগ। ইসমত কাদির গামা, মমতাজ হোসেন, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, সৈয়দ নরুল ইসলাম এবং আমি, মিলে কামাল ভাইকে ছাত্রলীগে ফিরিয়ে আনার কাজটি করি। ছাত্রলীগ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের মোকাবিলায় আবার ঘুরে দাঁড়ায় শেখ কামালের নেতৃত্বে, ঢাকা শহর আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনেকটাই থিতিয়ে পড়া ছাত্রলীগ কর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসে। ইতিমধ্যে দক্ষিণপন্থিদের ষড়যন্ত্রও ছাত্রলীগকে ঘিরে ধরে। মুহসিন হলে সাত ছাত্রলীগ কর্মীকে খুন করার মর্মান্তিক ঘটনায় ছাত্রলীগের দক্ষিণপন্থি বিচ্যুতি প্রকট আকার ধারণ করে। এই নতুন সংকট মোকাবিলায়ও নেতৃত্ব দেন শেখ কামাল।
ছাত্র আন্দোলনের এই কঠিন ও সংকটকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় নেতৃত্ব প্রদানের পাশাপাশি তারুণ্যের মূর্ত প্রতীক শেখ কামাল তার সৃজনশীল ও সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডও অব্যাহত রাখেন শিল্প, সংস্কৃতি আর ক্রীড়া জগতে। সেতার বাজাতেন শেখ কামাল, মঞ্চ দাপিয়ে নাটক করেছেন, খেলেছেন প্রথম বিভাগে ফুটবল, ক্রিকেট আর বাস্কেটবল। গড়ে তুলেছেন স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী, বাজাসান্দো, নাট্যচক্র আর আবাহনী ক্রীড়া চক্র। এক কথায় শেখ কামাল ছিলেন এক চৌকশ ও প্রাণবন্ত যুবক। তার অকাল শাহাদত বাংলাদেশের সৃজনশীল বহু ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়েছে। বেঁচে থাকলে শিল্পচর্চা, সংস্কৃতির ও ক্রীড়ার বিকাশে বাংলাদেশ বড় অর্জনের সম্ভাবনায় থাকত। কতিপয় ঘৃণ্য সরীসৃপের কারণে এই প্রতিভাদীপ্ত মানুয়টির সৃষ্টিশীলতা থেকে বঞ্চিত হয়েছে বাংলাদেশ।
কামাল ভাইয়ের বন্ধুমহলে রাজনীতির পরিধি সীমাবদ্ধ থাকেনি। ছাত্র-যুবাদের সব সমাবেশেই তার বন্ধু ও অনুসারীদের উপস্থিতি দৃশ্যমান। সদা হাসিখুশি কামাল ভাই ছিলেন বন্ধুবত্সল, বিনয়ী, ভদ্র ও আড্ডাপ্রিয়। নিরহংকার, সদালাপী ও সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। একবার যারা তার সংস্পর্শে এসেছেন কেউ তাকে ভুলতে পারেনি। এমনকি অধ্যাপক আবুল ফজলও। তিনি তার একটি লেখায় অত্যন্ত স্নেহের ভাষায় শেখ কামালকে স্মরণ করেছেন। যে কাজেই তিনি অংশ নিয়েছেন তা তিনি করেছেন একাগ্রতা নিয়ে। সব কাজেই তার ছিল মনোযোগ। রাজনীতি, ক্রীড়া, সংস্কৃতি—সর্বত্রই তার অংশগ্রহণ ছিল সাবলীল। নিজ কর্ম ও লক্ষ্যে তিনি ছিলেন প্রগাঢ় নিষ্ঠাবান।
শেখ কামাল নিঃসন্দেহে একজন আদর্শ যুবক। তার জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়ার আছে আজকের ছাত্র-যুবকদের। তাকে অনুসরণ ও অনুকরণ করলে আমাদের ছাত্র-যুবসমাজ পথের দিশা পাবে বলে আমি মনে করি। আমি আজকের যুবসমাজকে অনুরোধ করব তাকে অনুসরণ করতে। বন্ধুপ্রীতি ও সহকর্মীদের প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ তার জীবনাদর্শের এক উল্লেখযোগ্য অংশ। মুজিবাদর্শে তার আস্থা ছিল গভীর (যা সাম্প্রতিক সময়ে মৌখিক লৌকিকতায় পরিণত হয়েছে)। আমরা মনে করি শহিদ শেখ কামালের জীবনাচরণের পথ ধরে হাঁটলেই বাংলার তরুণসমাজ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশ গড়তে সক্ষম হবেন।
লেখক : সংসদ সদস্য, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা,
পঁচাত্তর-পরবর্তী প্রতিরোধ যোদ্ধা;
সম্পাদক, মত ও পথ।