বাংলাদেশ কি একুশ শতকের নতুন উপনিবেশ

আবদুল মান্নান

আবদুল মান্নান
আবদুল মান্নান। ফাইল ছবি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। এই সময়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রদূতদের দৌড়ঝাঁপ দেখে মনে হচ্ছে, এই একুশ শতকে এসে বিশ্ব এক নতুন উপনিবেশের জন্ম দেখতে পাচ্ছে, যার নাম বাংলাদেশ। দেশটিকে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ মানুষ জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। যে দেশটি রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্মের তীব্র বিরোধিতা করেছিল, যারা আমাদের প্রতিপক্ষকে সব ধরনের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, যে দেশটিকে জন্মের মুহূর্তে গলা টিপে হত্যা করতে চেয়েছিল, সেই একই দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫২ বছর পর মওকা বুঝে তাদের সেই পুরনো আকাঙ্ক্ষা পূরণের সুযোগ পেয়ে গেছে। সঙ্গে পেয়েছে তাদের কিছু তাঁবেদার ইউরোপীয় রাষ্ট্রের সার্বিক সহায়তা। আরো সঙ্গে আছে তাদের অর্থে পোষা এ দেশীয় কিছু মতলববাজ সুধী ও প্রতিষ্ঠান, যারা নিরপেক্ষতার আড়ালে এসব পরাশক্তির স্বার্থ রক্ষা করার জন্য তাদের নিজেদের সব কর্মকাণ্ড ও জীবন উৎসর্গ করেছে। এরা সমাজের বা নাগরিক সমাজের পণ্ডিত সদস্য বা বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত। সঙ্গে আছে বেশ কিছু মিডিয়া ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

এদের মধ্যে একটি অভিন্ন দর্শন কাজ করে। যার একটি হচ্ছে, বাংলাদেশ যদি শয়তানও শাসন করে তা-ও ভালো, আওয়ামী লীগ যেন না করে। বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ এদের জানি দুশমন। যারা এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত তারা সবাই বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের অর্থায়নে পরিচালিত হয় এমন তথ্য তাদের ওয়েবসাইটেই আছে।

universel cardiac hospital

আধুনিক বিশ্বে তো বটেই, সেই প্রাচীন কাল থেকে এক দেশের প্রতিনিধি অন্য দেশে তাঁর দেশের প্রতিনিধিত্ব করার একটা রেওয়াজ চালু রয়েছে। এই প্রতিনিধিরা আন্তর্জাতিকভাবে দূত বা রাষ্ট্রদূত হিসেবে পরিচিত। এই রাষ্ট্রদূতদের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নত করে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা। এই কাজগুলো করতে গিয়ে তাঁদের যেখানে কর্মস্থল সেই দেশের আইন মেনে চলতে হয়।

আবার এসব রাষ্ট্রদূতের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার জন্য জাতিসংঘ ১৯৬৯ সালে একটি আইন করে দিয়েছে, যা ভিয়েনা কনভেনশন দলিল হিসেবে পরিচিত। এটি জাতিসংঘের সব সদস্য দেশের দূতদের সব সময় মেনে চলতে হয়। এই দলিলের ৪১ ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে, একজন রাষ্ট্রদূত যে দেশে কর্মরত আছেন তাদের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। তাঁদের সব কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সব সময় স্বাগতিক দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অথবা অন্য কোনো নির্ধারিত মন্ত্রণালয়কে অবহিত রাখতে হবে। তার ওপর আছে স্বাগতিক দেশের আইন। স্বাগতিক দেশের বা ভিয়েনা কনভেনশনে বর্ণিত আইনের কোনো ধারা কোনো রাষ্ট্রদূত কখনো অম্যান্য করতে পারেন না। করলে স্বাগতিক দেশ ওই রাষ্ট্রদূতকে নিজ দেশ থেকে বহিষ্কার করতে পারে। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তান দূতাবাসের সহকারী ভিসা অফিসার মাজহার খানকে জাল মুদ্রা চোরাচালানের দায়ে গ্রেপ্তার করে নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়েছিল। একই বছরের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের আরেক কর্মকার্তা ফারিনা আহমেদ এই দেশে জঙ্গিবাদে অর্থায়নের দায়ে অভিযুক্ত হলে তাঁকে ফেরত পাঠানো হয়। যুক্তরাষ্ট্র নিয়মিত বিরতি দিয়ে সেই দেশ থেকে রাশিয়া বা চীনের দূতাবাসের কর্মকর্তাদের ২৪ ঘণ্টার নোটিশ দিয়ে বহিষ্কার করে। ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে বাইডেন সরকার যুক্তরাষ্ট্র থেকে রাশিয়ার দূতাবাসের ১০ কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করেছে। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে হুমকির মুখে ফেলেছিলেন।

ঔপনিবেশিক আমলে বাংলায় ইংরেজদের স্বার্থ দেখাশোনা করতে সেই দেশ থেকে যেসব রাজপ্রতিনিধি এই দেশে আসতেন তাঁদের প্রথমে বলা হতো গভর্নর জেনারেল এবং পরবর্তীকালে ভাইসরয়। এই দেশে এই ভাইসরয়রা হয়ে ওঠেন দেশের মানুষের ভাগ্যবিধাতা। বর্তমানে বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতদের ভূমিকা দেখে মনে হতে পারে এসব রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশকে তাঁদের উপনিবেশ জ্ঞান করেন এবং তাঁরা এই দেশে নব্য ভাইসরয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ হয়েছে জাতিসংঘের কিছু মানবাধিকার কর্মকর্তা আর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে রাতের ঘুম হারাম করে দৌড়ঝাঁপের নেতৃত্বে আছেন এ দেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত। অনুগত হিসেবে তাঁর সঙ্গে আছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু রাষ্ট্রদূত। তাঁরা সবাই ভিয়েনা কনভেনশন নামের দলিলটি জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়েছেন। যখন-তখন এ দেশের রাজনীতি নিয়ে বিবৃতি দিচ্ছেন, পরামর্শ দিচ্ছেন আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে। ভারসাম্য রক্ষা করার নীতি হিসেবে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রী আর কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করার অসিলায় সামনের নির্বাচন নিয়ে পরার্মশ দিতে। যার কোনোটাই তাঁদের কাজের মধ্যে পড়ে না। বাংলাদেশে ৬৪টি দেশের রাষ্ট্রদূত দায়িত্ব পালন করেন। এই কজন বাদে অন্য কোনো দেশের দূতরা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এত দৌড়ঝাঁপ করেন না বা নিজেদের এ দেশের অঘোষিত ভাইসরয় মনে করেন না।

বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সকাল-সন্ধ্যা রুদ্ধদ্বার সভা করেন বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক দপ্তরের কয়েকজন নেতা। এঁদের একজনের পিতা তাঁর নিজ জেলায় ১৯৭১ সালে শান্তি কমিটির প্রধান ছিলেন। আরেকজনের পিতা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর তিনি খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বর কারাগারে চার জাতীয় নেতা হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ছিলেন। আদালতের রায়ে তিনি খালাস পান। প্রতিবার তাঁরা যখন এসব রুদ্ধদ্বার বৈঠক থেকে বের হন, তখন বেশ ফুরফুরে মেজাজে থাকেন। এর কয়েক দিন পর আবার তাঁরা ফুটো বেলুনের মতো চুপসে যান। ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনের শেষ সময়ে এসে একজন অরাজনৈতিক প্রার্থী কিছু উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তির হাতে নাজেহাল হন। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে বেশ কয়েকজন যুবককে গ্রেপ্তার করে। এই ঘটনার ২৪ ঘণ্টা না যেতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১২ জন রাষ্ট্রদূত দেশে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হয়েছে বলে চিৎকার শুরু করে দেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি। মাসখানেক আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যতম সদস্য দেশ ফ্রান্সে পুলিশের গুলিতে এক যুবক নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে সপ্তাহখানেক ধরে সেই দেশে চলল ভয়াবহ তাণ্ডব, যা দমন করতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রচণ্ড শক্তি প্রয়োগ করে। তখন কিন্তু জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র অথবা ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো দেশ প্রতিবাদ করেনি। শুক্রবার জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন এক বিবৃতি দিয়ে বাংলাদেশকে পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশে বিক্ষোভ থামাতে যেন পুলিশ অতিরিক্ত বল প্রয়োগ না করে। যুক্তরাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী যখন বুটের তলায় পিষে মানুষ মারে অথবা ফ্রান্সের পুলিশ দাঙ্গাকারীদের থামাতে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তখন কোথায় থাকে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন? বাংলাদেশে ‘সম্মিলিত সরকার হটাও পার্টি’ যখন বিক্ষোভের নামে জনগণের সম্পদে আগুন দেয় তখন কি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী রাস্তায় রবীন্দ্রসংগীতের আসর বসাবে!

মানবাধিকার নিয়ে যে দেশটি সর্বদা কথা বলে সেই যুক্তরাষ্ট্রে মানবাধিকার কোনো দিনই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় বলে বিবেচিত হয়নি। লন্ডন থেকে প্রকাশিত গত ২ আগস্টের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তরক্ষীদের হাতে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমকারী মেক্সিকানদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। গণতন্ত্রের কথা যুক্তরাষ্ট্র যত কম বলে ততই মঙ্গল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের কত দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে উত্খাত করেছে তার হিসাব নেই। থাইল্যান্ডে মে মাসের ১৪ তারিখ সাধারণ নির্বাচন হলো। নির্বাচনে সেনাসমর্থিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রিয় সরকারের ভরাডুবি হয়। সেই নির্বাচনে তরুণদের ‘মুভ ফরওয়ার্ড পার্টি’ জয় লাভ করে। কিন্তু তারা এখন পর্যন্ত সেখানে কোনো সরকার গঠন করতে পারেনি। আরো ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, যে তরুণটি দলের হয়ে সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন তাঁকে সেই দেশের উচ্চ আদালত প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করেছেন। কোথায় গেল যুক্তরাষ্ট্রসহ গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালারা? অবশ্য সেই দেশে কোনো দেশের রাষ্ট্রদূত ভাইসরয়ের ভূমিকা পালন করেন না, যেমন করেন বাংলাদেশে।

যেদিন বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে নির্বাচন বিষয়ে জানতে চাইতে গেলেন সেদিনই তিনি ভিয়েনা কনভেনশনের তো বটেই; বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছেন। বিষয়টি আরো কদর্য রূপ ধারণ করেছে যখন বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার আর রাষ্ট্রদূত একই সঙ্গে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদটি একটি সাংবিধানিক পদ, আর বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার একজন সিনিয়র সচিবের পদমর্যাদার কর্মকর্তা ছিলেন। একজন রাষ্ট্রদূতের মর্যাদা কোনো অবস্থায়ই একজন যুগ্ম সচিবের ঊর্ধ্বে নয়। আমাদের প্রধান নির্বাচন কমিশনার সম্ভবত তাঁর অবস্থান সম্পর্কে কিছু সময় অবহিত ছিলেন না। রাষ্ট্রদূত মহোদয় আওয়ামী লীগ দপ্তরে গেলে তাঁকে জামাই আদরে বরণ করে নেওয়া হয়, যার কোনো প্রয়োজন ছিল না।

সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দেউলিয়াত্ব সম্পর্কে এত দিনে বাংলাদেশে স্বঘোষিত ভাইসরয়রা ধারণা পেয়ে থাকবেন। এখন সময় হয়েছে তাঁদের দৌড়ঝাঁপ বন্ধ করে পেশাদার কূটনীতিবিদ হিসেবে আচরণ করার। তাঁদের নিজ নিজ দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক অভিন্ন স্বার্থ আছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগী। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে দেশটি স্বাধীন হয়েছে। ৫২ বছর পর এ দেশের মানুষ অন্য কারো তাঁবেদার হতে চায় না। বাংলাদেশকে উপনিবেশ হিসেবে দেখা বন্ধ হোক। এ দেশে কোনো ভাইসরয়ের প্রয়োজন নেই। অবসর সময়ে সংশ্লিষ্ট কূটনীতিবিদরা ভিয়েনা কনভেনশনটা আবার একটু পড়ে নিতে পারেন।

আগস্টের শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

শেয়ার করুন