আ. লীগের বিশেষ বর্ধিত সভা: প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার নির্দেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দলের তৃণমূলের নেতাদের উদ্দেশে বলেছেন, আমরা যাকেই মনোনয়ন দিই—ভালো-মন্দ, কানা-খোঁড়া যা-ই হোক—প্রতিজ্ঞা করতে হবে, আপনারা তাকেই জয়ী করার জন্য কাজ করবেন।’ শেখ হাসিনা গতকাল রবিবার বিকেলে আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভায় সমাপনী বক্তব্যে এ কথা বলেন। তিনি দলের মনোনীত প্রার্থীদের ভোট দেওয়ার জন্য উপস্থিত নেতাদের দুই হাত তুলে প্রতিজ্ঞা করতেও বলেন। এ সময় নেতারা হাত তুলে প্রতিজ্ঞা করেন।

সভায় উপস্থিত একাধিক সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

universel cardiac hospital

সভায় দলের নেতাদের সতর্ক করে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মনোনয়ন দেওয়ার পর কেউ যদি মনে করেন, এই একটা সিট পেলেই কী হবে আর না পেলেই কী হবে, অন্য সিট পেলেই তো ক্ষমতায় যাব; কিন্তু দেখা যাবে এভাবে সব সিটে হেরে যাবেন। তারপর ২০০১-এর নির্বাচনে হারার পর বিএনপির যে অত্যাচার-নির্যাতন—মনে আছে সবার? নাকি ভুলে গেছেন? তাহলে এবার বোঝেন যদি আপনারা সামনের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসতে না পারেন, তাহলে আমাদের নেতাকর্মী—তাদের সঙ্গে কী নির্যাতন হবে। আর বাংলাদেশটার অবস্থা কী হবে।

ওরা তো লুটে খাবে। এরা তো লুটেরা। হাজার হাজার কোটি টাকা চুরি করে এখন লন্ডনে বসে যত রকম অপকর্ম করে যাচ্ছে।’

গতকাল রোববার সকালে ‘শত সংগ্রামে অজস্র গৌরবে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে’ শীর্ষক বর্ধিত সভায় সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি।

সকাল ৯টা থেকেই তৃণমূলের নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা গণভবনে প্রবেশ করতে শুরু করেন। সকাল সাড়ে ১০টার কিছু পরে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা মঞ্চে আসেন। শুরুতে বক্তব্য দেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সভাটি সঞ্চালনা করেন দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপ। দলের নেতাদের উদ্দেশে আওয়ামী লীগ সভাপতি বক্তব্য দেওয়ার পর তৃণমূলের নেতাদের কথা শোনেন কেন্দ্রীয় নেতারা।

আট বিভাগের প্রতিটি থেকে একাধিক জেলা, উপজেলার নেতারা বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পান।

সভায় দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, আওয়ামী লীগের জেলা, মহানগর, উপজেলা ও পৌরসভা ইউনিটের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের মনোনয়নে অথবা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত জেলা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়র, সহযোগী সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা সভায় উপস্থিত ছিলেন।

সভায় তৃণমূলের নেতাদের উদ্দেশে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘মনোনয়ন যাকেই দিই। আমি কিন্তু ঘরে বসে থাকি না, সারা দিন কাজ করি। সংগঠনের কাজও করি। কোথায় কার কী অবস্থা সেটা কিন্তু ছয় মাস পর পর জরিপ করি। আমাদের এমপিদের কী অবস্থা, অন্য জনপ্রতিনিধিদের কী অবস্থা, তার একটা হিসাব নেওয়ার চেষ্টা করি। জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এর ওপর নির্ভর করছে আমাদের ক্ষমতায় যাওয়া বা না যাওয়া। সে কথাটা মাথায় রেখে, আমাদের ওপর ভরসা রাখতে হবে। আমরা যখন মনোনয়ন দেব অবশ্যই আমাদের একটা হিসাব থাকবে যে কাকে দিলে আমরা আসনটা ফিরে পাব।’

দলের নেতাদের অনেকেই একে অন্যের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার কাছে অভিযোগ জানান। এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘অনেক এসএমএস দিলে, গিবত গাইলেই কিন্তু আমি তাদের কথা শুনব এমন না। এটা আমি স্পষ্ট বলে দিচ্ছি। কারণ আমার নিজের হিসাব-নিকাশ আছে। ৪২ বছর আপনাদের সঙ্গে আছি। ১৯৮১ সালে সভাপতি নির্বাচিত করেছেন। এরপর কিন্তু আমি প্রতিটি এলাকায় ঘুরে ঘুরে দেখেছি। ফলে আমার কিন্তু ধারণা আছে। কার অবস্থা কী সেটা বুঝেই কিন্তু আমরা মনোনয়ন দিই।’

বিরোধী দলের আন্দোলনের সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের গণভবনে একটা ছাগলের তিনটা বাচ্চা আছে। দুইটা দুধ খায় আর একটা এমনিতেই লাফায়। বিএনপি-জামায়াত হলো ওই দুইটা। বাকিরা এমনিতেই লাফায় আর আন্দোলন আন্দোলন করে। এ ক্ষেত্রে আমাদের একমাত্র শক্তি আমাদের জনগণ।’

সরকার দল-মত-নির্বিশেষে সবার জন্য উন্নয়ন করছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ঘর দিয়েছি। কে আওয়ামী লীগ, কে বিএনপি তা দেখিনি। কে ভূমিহীন সেটা দেখেছি। আমরা সেভাবেই উন্নয়ন করতে চাই।’

ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব পেলেন

সভায় পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কানাই লাল বিশ্বাস আওয়ামী লীগ সভাপতির কাছে পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব চান। এ সময়ে তাঁকে পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব দেন শেখ হাসিনা। এরপর আরো একাধিক জেলার ভারপ্রাপ্ত সভাপতিও পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব চান। শেখ হাসিনা তখন সব জেলা, উপজেলা মহানগরের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে যাঁরা ভারপ্রাপ্ত হিসেবে আছেন, তাঁদের পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব দেওয়ার ঘোষণা দেন।

জনপ্রিয় ব্যক্তি ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার দাবি

সভায় উপস্থিত সূত্র জানায়, তৃণমূলের একাধিক নেতা বক্তব্যে ত্যাগী, জনপ্রিয় ব্যক্তি ও দুর্দিনের ছাত্রলীগ নেতাদের মনোনয়ন দেওয়ার অনুরোধ জানান। হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর চৌধুরী বলেন, আগামী নির্বাচনে ছাত্রলীগ থেকে উঠে আসা নেতাদের মনোনয়ন দেওয়ার পাশাপাশি দলের কাজে লাগানো দরকার। জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিজন কুমার দাস আগামী দিনে প্রার্থী চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে জনপ্রিয়দের অগ্রাধিকার দেওয়ার অনুরোধ জানান। নির্বাচনের আগেই জেলার সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলোর সম্মেলন দেওয়ার অনুরোধ জানান।

কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন বলেন, সব ভেদাভেদ ও কোন্দল দূর করে আগামী জাতীয় নির্বাচনেও জেলার ছয়টি আসনেই নৌকার বিজয় উপহার দেওয়া হবে। তিনি জরিপের ভিত্তিতে জনপ্রিয়দের মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানান।

এমপির ওপর ক্ষোভ তৃণমূলের নেতাদের

একাধিক সূত্র জানায়, সভায় কয়েকজন নেতা তাঁদের বক্তব্যে সংসদ সদস্যদের ভূমিকার সমালোচনা করেন।

পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী আলমগীর বলেন, জেলার তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ভালো নেই। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই দলের দুস্থ ও গরিব নেতাকর্মীদের খোঁজখবর রাখেন না। জেলার সব উপজেলায় সাংগঠনিক অবস্থা ভালো আছে। কিন্তু বাউফল উপজেলায় অনেক দিন যাবৎ বিরোধ চলছে। সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের গ্রুপিংয়ের কারণে প্রায়ই সেখানে মারামারির মতো ঘটনা ঘটছে। নির্বাচনের আগেই এই সমস্যা সমাধানে দলের সাধারণ সম্পাদকের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।

শেখ হাসিনার উদ্দেশে সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুস সামাদ তালুকদার বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা আজকে আপনার সামনে কমিটমেন্ট করে যাব যে আমরা দলের ভেতরে কোনো বিভাজন করব না। নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াব। মানুষের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক বাড়াব। এখান থেকে বের হয়ে দলবল নিয়ে গিয়ে এলাকায় গ্রুপিং করব, এটা যেন না হয়। যাকেই মনোনয়ন দেবেন আমরা তার পক্ষেই কাজ করব। উপজেলাগুলোতে কমিটি করে আমরা কাজ করছি। কিন্তু সমন্বয়ের অভাবে আমরা কাজগুলো স্থায়ী রাখতে পারছি না।’

বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তালুকদার মোহাম্মদ ইউনুস বলেন, ‘অনেকেরই এমপি হওয়ার স্বপ্ন থাকতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।’ দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলতাফুজ্জামান মিতা অভিযোগ করেন, দিনাজপুরের একজন সংসদ সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে আসছেন। ওই সংসদ সদস্য দলীয় শৃঙ্খলা মানেন না। যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন অভিযোগ তোলেন, এমপিরা নেতাকর্মীদের কোনো খোঁজখবর রাখেন না।

আরও যা বললেন তৃণমূলের নেতারা

লালমনিরহাট জেলার সাধারণ সম্পাদক মতিয়ার রহমান লালমনিরহাটে আগামী দিনে লাঙলের পরিবর্তে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানান। এ সময় লালমনিরহাটের উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরেন তিনি। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, লালমনিরহাট তো লালে লাল হয়ে গেছে। অনেক কিছু দিয়েছি।

ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য নিজাম হাজারী বলেন, খালেদা জিয়ার জন্মস্থান হওয়ায় ফেনী একসময় বিএনপির ঘাঁটি ছিল। সাড়ে ১৪ বছরে জেলার প্রতিটি এলাকায় উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। ফলে জেলায় ভোটের চিত্রও বদলে গেছে। ফেনী এখন আওয়ামী লীগের ঘাঁটি।

শেয়ার করুন