বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১২ খুনির মধ্যে ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। আর জিম্বাবুয়েতে পলাতক থাকা অবস্থায় একজনের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। বাকি পাঁচ খুনি এখনো পলাতক। নির্মম-নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ৪৭ বছর পার হয়ে গেলেও তারা রয়ে গেছেন অধরা। এ পাঁচজনকে দেশে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। তবে তাতে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।
কূটনৈতিক প্রক্রিয়া, গোয়েন্দা ও ইন্টারপোলের মাধ্যমে চেষ্টা চালিয়ে দুজনের অবস্থান জানা গেলেও বাকি তিনজন কোথায় আছেন তা নিশ্চিত হতে পারেনি সরকার। ১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার পেছনের ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজে বের করতে কয়েক বছর আগে সরকার একটি কমিশন গঠনের পরিকল্পনা করলেও, তা এখনো আলোর মুখ দেখতে পায়নি।
তবে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করতে পেরেছে। আবদুল মাজেদ দীর্ঘদিন দেশের বাইরে পালিয়ে ছিলেন। ২০২০ সালের ১২ এপ্রিল তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার বিচার শেষ হয়েছে ১৩ বছর আগে। পলাতকদের মধ্যে দুজনের অবস্থান জানা গেলেও বাকি তিনজন কোথায় আছেন তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, এ তিনজন এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে আসা-যাওয়া করছেন।
২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে চূড়ান্ত রায় দেন। এরপর ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ফাঁসি কার্যকর হয় পাঁচ আসামির।
তারা হলেন- লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর বজলুল হুদা, লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি) ও লে. কর্নেল এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার)।
অন্যদিকে, পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা যান আজিজ পাশা। সবশেষ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মধ্যে আব্দুল মাজেদের ফাঁসি হয়। ২০১৯ সালের ৭ এপ্রিল রাতে রাজধানীর মিরপুর থেকে গ্রেফতার হন তিনি। এর পাঁচদিন পর ১২ এপ্রিল কার্যকর হয় তার ফাঁসি। তিনি দীর্ঘদিন ভারতে পালিয়ে ছিলেন।
বাকি পাঁচ খুনির মধ্যে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। আর কানাডায় আছেন নূর চৌধুরী। তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলেও সফল হচ্ছে না সরকার। এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশের নিজস্ব আইন।
এদিকে খন্দকার আব্দুর রশিদ, শরীফুল হক ডালিম ও মোসলেম উদ্দিনের কোনো সন্ধান নেই। তারা কোথায় আছেন তার সুনিশ্চিত তথ্য নেই সরকারের কাছে। যদিও তাদের গ্রেফতারে ইন্টারপোলের পরোয়ানা জারি রয়েছে।
তবে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, খন্দকার আবদুর রশিদ কখনো পাকিস্তান কখনো লিবিয়ায় অবস্থান করছেন। আর শরীফুল হক ডালিম রয়েছেন পাকিস্তানে। তবে এসব তথ্য যে পুরোপুরি নিশ্চিত তা বলা যাচ্ছে না।
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, রাশেদ চৌধুরী ও নূর চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে। একই কথা বলেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এবং আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক।
সোমবার (১৪ আগস্ট) পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, পলাতক খুনিদের সন্ধানদাতাদের পুরস্কৃত করা হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাংবাদিক ফোরাম আয়োজিত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আলোচনা সভায় এ কথা বলেন তিনি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মধ্যে সাতজন ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় পলাতক দুইজনকে ফেরত পাঠাতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো সহযোগিতা করছে না। বাকি খুনিরা কোথায় আছেন এ বিষয়ে সরকারের কাছে কোনো তথ্য নেই। তাদের বিষয়ে নাগরিকরা তথ্য দিতে পারলে পুরস্কৃত করা হবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফেরানোর বিষয়ে আমাদের কাছে প্রায়ই জানতে চাওয়া হয়। আমি যতটুকু জানি- ১৫ আগস্টের ঘাতকদের মধ্যে পাঁচজনকে ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে। ২০২০ সালের দিকে আরেকজনের রায় কার্যকর করা হয়। বাকিদের মধ্যে পাঁচজনের হদিস মেলেনি।
খুনি রাশেদ চৌধুরী ও নূর চৌধুরীকে ফেরানোর জন্য অনেক চিঠিপত্র লেখা হয়েছে জানিয়ে ড. মোমেন বলেন, ‘এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিয়েও আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে আমরা চিঠি দিয়েছি। তারা সবসময় আমাদের বলেন, এ ইস্যুটা তাদের অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে আছে। অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস আমাদের দুবছর আগে অর্থাৎ ট্রাম্প প্রশাসনের সময় উনি (মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল) চাইলেন যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার যে কেসটা হয়েছিল, সেটার বিস্তারিত তথ্য চেয়েছিলেন। আমরা সব তথ্য তাদের দিয়েছি। এরপর যতবার আমি স্টেট ডিপার্টমেন্টে অ্যাপ্রোচ করেছি, তারা বলেন, এটা অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে আছে। আর নতুন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’
নূর চৌধুরীকে ফেরাতে কানাডার আদালতে মামলাও করা হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কানাডায় থাকা নূর চৌধুরীর অবস্থানও কানাডা সরকার বলতে চায় না। এজন্য আমরা কানাডার আদালতে মামলাও করেছি। বিচারক রায় দিয়েছেন যে, তার (নূর) অবস্থান জানাতে কানাডার সরকারের কোনো আপত্তি থাকা উচিত নয়। তবুও কানাডা সরকার তার তথ্য আমাদের দেয়নি।’
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ (এএম) আমিন উদ্দিন বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো যারা আইনের কথা বলেন, মানবাধিকারের কথা বলেন তাদের দেশেই কিন্তু ১৫ আগস্টের খুনিরা আত্মগোপনে রয়েছেন। প্রত্যেক দেশের দায়িত্ব আদালতে যাদের বিরুদ্ধে দণ্ড রয়েছে তাদের ডিফেন করার সুযোগ করে দেওয়া। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর খুনিরা রায়ের প্রথম থেকেই পলাতক। আসামিদের ফেরত দিয়ে দেশে দণ্ডটি কার্যকর করবেন সেটা আমি আশা করি।
বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চলছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন। কয়েকজনের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে। কয়েকজন দেশের বাইরে পলাতক রয়েছেন। সরকার তাদেরও দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। আমাদের আওতায় এলেই তাদের রায় কার্যকর করা হবে। আমরা কাউকেই ছাড়বো না।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৪৮তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে শুক্রবার (১১ আগস্ট) তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা যুবলীগ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এ কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এ রায় কার্যকরের মধ্যদিয়ে হৃদয়ের ক্ষোভের আগুন কিছুটা হলেও নিভেছে। কিন্তু সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্যদিয়ে যে কালিমা লেপে দেওয়া হয়েছিল, গোটা বঙ্গোপসাগরের পানি দিয়ে আমাদের শরীর ধুয়ে দিলেও সেই কলঙ্কের দাগ যাবে না।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, পলাতক ঘাতকদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চেষ্টা করছে। আর আইনমন্ত্রী তো বলছেন, একেক দেশের আইন একেক হওয়ায় আসামিদের ফিরিয়ে আনায় জটিলতা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, কানাডা ও আমেরিকার আইন মেনে চেষ্টা করতে হবে আমাদের। এ সরকার আসার পর থেকেই ডিপ্লোমেটিক্যালি ঘাতকদের ফেরাতে চেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের মধ্যে মাজেদ ধরা পড়েছিলেন। আর বাকিদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত আছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে ঘাতকদের বুলেটের আঘাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ভবনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ হন। ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তার সহধর্মিণী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তিন ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, ১০ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, একমাত্র সহোদর বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসেরসহ আরও অনেককে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ডের আত্মস্বীকৃত খুনিদের পরবর্তীকালে দূতাবাসে চাকরিসহ বিদেশে পুনর্বাসন করে তৎকালীন সামরিক সরকার।
শেষপর্যন্ত এ হত্যা মামলায় ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকার তৎকালীন দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল বিচার শেষে ১৫ জন আসামির মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করেন। তবে আপিলের রায়ে খালাস পান তিনজন। বাকি ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে।
সবশেষ ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করে আপিল বিভাগ। তাতে আসামিদের করা রিভিউ পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ হয়ে গেলে পাঁচ খুনির ফাঁসির কার্যকর করে জাতিকে দায়মুক্ত করা হয়।