সর্বজনীন পেনশন সুবিধার জন্য যা করতে হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক

সংগৃহীত ছবি

সরকারের সর্বজনীন পেনশন স্কিম কর্মসূচি যাত্রা শুরু করেছে। কোনও সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই সুবিধা পাবেন না। এমনকি যারা সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন সুবিধা পাচ্ছেন তারাও এ সুবিধার আওতায় আসবেন না। তবে এরা কেউ যদি সর্বজনীন বেসরকারি পেনশন সুবিধা পেতে চান তাহলে তাকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় যে সুবিধা পান তা সমর্পণ করে আসতে হবে। তবেই তিনি সর্বজনীন পেনশনের সুবিধা পাবেন। আগামী দিনে বেসরকারি চাকরি থেকে অবসরে গিয়েও পেনশন সুবিধা ভোগ করা যাবে।

জারি হওয়া সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালায় ধারা (৪)-এর উপধারা (৩)-এ বলা হয়েছে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতাভুক্ত ব্যক্তিরা এই কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারবেন। তবে শর্ত হচ্ছে– এ স্কিমে অংশ নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা সমর্পণ করতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার (১৭ আগস্ট) এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেন, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য এই পেনশন স্কিম চালু করা হয়েছে। এই ব্যবস্থা সমাজের বৈষম্য কমাতে সহায়তা করবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের আত্মতুষ্টির বিষয়টি হলো আমরা যে অঙ্গীকার করি, সেটা আমরা রাখি।

কারা পাবেন এই সুবিধা

এ কর্মসূচির আওতায় ১৮ থে কে ৫০ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য পেনশনের ব্যবস্থা থাকবে। ৫০ বছরের বেশি বয়সীরাও এতে অংশ নিতে পারবেন। তবে তাদের ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে, অংশ নেওয়ার দিন থেকে টানা ১০ বছর চাঁদা পরিশোধ করতে হবে। এরপর তিনি যে বয়সে উপনীত হন, সে বয়স থেকে পেনশন পাবেন।

চাঁদা কত

ঘরে বসেই পেনশন কর্মসূচির আওতায় চাঁদা দেওয়া যাবে। এ জন্য একটি অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে। মাসিক চাঁদা হবে সর্বনিম্ন এক হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা। সর্বনিম্ন এক হাজার টাকার সঙ্গে সরকার আরও ৫০০ টাকা দেবে। পেনশন ব্যবস্থায় নগদ টাকায় কোনও লেনদেন হবে না। সব কর্মকাণ্ড হবে অনলাইনে। মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ব্যবহার করেও চাঁদা দেওয়া যাবে।

কীভাবে চাঁদা দেওয়া যাবে

সর্বজনীন পেনশনের আওতায় আসতে হলে নিবন্ধন করতে হবে। ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী সব নাগরিক তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় যোগ দিতে পারবেন। যেসব প্রবাসী বাংলাদেশির এনআইডি নেই, তারা বৈধ পাসপোর্টের ভিত্তিতে ব্যাংকিং চ্যানেল, অনুমোদিত মোবাইল আর্থিক পরিষেবা এবং এক্সচেঞ্জ হাউজের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রায় চাঁদা দিয়ে কর্মসূচিতে যুক্ত হতে পারবেন।

নিবন্ধনের পর একটি নম্বর পাওয়া যাবে, যা দিয়ে সবসময় চাঁদা পরিশোধসহ সব কাজ করা যাবে। গ্রামীণ পর্যায়ে নিবন্ধন করতে সহযোগিতা করবে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার।

সুবিধা পাওয়া যাবে যেভাবে

সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা অনুযায়ী, এ কর্মসূচিতে যুক্ত হলে ৬০ বছর বয়সের পর থেকে একজন গ্রাহক আজীবন পেনশন সুবিধা পাবেন। নির্ধারিত পরিমাণের চাঁদা পরিশোধের পর গ্রাহক মারা গেলে তার নমিনি বা উত্তরাধিকারী এই পেনশন পাবেন ১৫ বছর।

সূত্র জানিয়েছে, ১৮ বছর বয়সে যেকোনও বেসরকারি নাগরিক এই কর্মসূচিতে যুক্ত হলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা মিলবে। যুক্ত হয়ে বয়স যত বাড়বে, আনুপাতিক হারে সুবিধা ততটাই বাড়তে থাকবে। এভাবে গ্রাহক যত টাকা চাঁদা হিসেবে জমা দেবেন তিনি তার জমা দেওয়া চাঁদার (কিস্তি) চেয়ে সর্বনিম্ন ২ দশমিক ৩০ গুণ থেকে সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ৩১ গুণ টাকা পেনশন পাবেন।

৭৫ বছর বয়সের আগে কোনও পেনশনার মারা গেলে তার নমিনি অবশিষ্ট সময়কালের পেনশন প্রাপ্য হবেন। ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগে কোনও পেনশনার মারা গেলে জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ নমিনিকে দেওয়া হবে। কোনও প্রয়োজনে চাঁদাদাতার আবেদনের ভিত্তিতে জমাকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসাবে নেওয়া যাবে এবং নির্ধারিত ফিসহ তা পরিশোধ করতে হবে। বিনিয়োগ বিবেচনায় পেনশনের চাঁদা কর রেয়াতযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। মাসিক পেনশন বাবদ পাওয়া অর্থ আয়করমুক্ত থাকবে।

বাতিল হওয়ার ঝুঁকি

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, দেশে সর্বজনীন পেনশন স্কিমটি সম্পূর্ণ নতুন। এজন্য কিছু নিয়ম-কানুন দিয়ে সম্প্রতি যে বিধিমালা জারি করা হয়েছে, সেখানে বলা হয় ধারাবাহিক তিনটি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে পেনশন হিসাব স্থগিত হবে। পরবর্তী সময়ে পুরো বকেয়া কিস্তি পরিশোধ না করা পর্যন্ত হিসাবটি সচল হবে না। নির্দিষ্ট তারিখে চাঁদা পরিশোধে ব্যর্থ হলে পরবর্তী এক মাস পর্যন্ত জরিমানাবিহীন পরিশোধ করা যাবে। এরপর প্রতিদিনের জন্য ১ শতাংশ হারে বিলম্ব ফি জমা দেওয়া সাপেক্ষে হিসাবটি সচল করা যাবে। এছাড়া একজন চাঁদাদাতা আগাম কিস্তি পরিশোধ করতে পারবেন।

সেখানে আরও বলা হয়, অসচ্ছল চাঁদাদাতার ক্ষেত্রে ১২ মাস পর্যন্ত কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে পেনশন হিসাবটি স্থগিত হবে না। আরও বলা হয়, কোনও চাঁদাদাতা ৭৫ বছরের আগে নিখোঁজ হলে এবং নিখোঁজ হওয়ার পর সাত বছর অতিবাহিত হলে তার হিসাব স্থগিত করে নমিনিকে টাকা ফেরত দেওয়া হবে। এছাড়া কেউ চাঁদা প্রদানকালে শারীরিক ও মানসিক অসামর্থ্যের কারণে স্থায়ী বা সাময়িকভাবে অর্থ উপার্জন না করতে পারলে তাকে অসচ্ছল চাঁদাদাতা ঘোষণা করতে কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নেবে।

সরকারের পেনশন কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে টাকা সংগ্রহের জন্য নির্ধারিত তফসিলি ব্যাংক বা ব্যাংকের শাখা, উপশাখাকে সম্মুখ অফিস হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে। সেক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনকালে এই সম্মুখ অফিসের কেউ দুর্নীতি বা অনিয়ম করলে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এছাড়া এই স্কিমের আওতায় চাঁদাদাতা স্কিমের স্বত্ব অন্য কোনও ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করতে পারবে না। তবে স্কিম চলাকালীন কেউ মারা গেলে মনোনীত নমিনির নামে হস্তান্তর করা যাবে। এছাড়া চাঁদাদাতা তার মোট জমানো অর্থের ৫০ শতাংশ ঋণ নিতে পারবেন। এটি পরবর্তী ২৪ কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে।

স্কিম চারটি

আইন অনুযায়ী, সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির আওতায় চারটি স্কিম থাকছে। প্রথম হচ্ছে ‘প্রবাসী’ স্কিম, যা প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য। বিদেশে কর্মরত প্রবাসীরা দেশি মুদ্রায় এই হিসাব খুলতে পারবেন। প্রবাসীরা ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড ও বৈধ চ্যানেলে এর কিস্তি পরিশোধ করতে পারবেন। দ্বিতীয় হচ্ছে ‘প্রগতি’ স্কিম, এটি বেসরকারি চাকরিজীবী ও প্রতিষ্ঠানের জন্য। তৃতীয় হচ্ছে ‘সুরক্ষা’ স্কিম, এখানে স্বকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তি এবং চতুর্থ ‘সমতা’ স্কিমে স্বল্প-আয়ের নাগরিকরা অংশ নেবেন। আপাতত সীমিত আকারে পেনশন কর্মসূচি চালু করা হবে।

সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর চাঁদার হার এবং স্কিম পরিবর্তন করার সুযোগ থাকবে।

উদ্বোধনের দিন ১৭ আগস্ট বৃহস্পতিবার থেকে অনলাইনে পেনশন কর্মসূচিতে চাঁদা দিয়ে অন্তর্ভুক্তি কার্যক্রম শুরু করতে আট জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়েছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ। এসব জেলা হচ্ছে, গোপালগঞ্জ, সিলেট, রংপুর, পাবনা, বাগেরহাট, ময়মনসিংহ, রাঙামাটি ও বরগুনা। কুয়ালালামপুর ও জেদ্দায় থাকা বাংলাদেশ মিশনেও এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আওতায় ছয়টি স্কিম থাকলেও প্রধানমন্ত্রী প্রগতি, সুরক্ষা, সমতা ও প্রবাসী স্কিম উদ্বোধন করেছেন।

এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরকারের এ কর্মসূচি আজ শুরু হলো। পরবর্তীতে এ কর্মসূচি সারা দেশে কাজ করবে। এতে সমাজের বৈষম্য কমবে। অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

শেয়ার করুন