আরব বসন্তের পর আরেক প্রতিবাদের মুখে বাহরাইন

মত ও পথ ডেস্ক

ছবি : ইন্টারনেট

বাহরাইনে গত মাসের ৭ তারিখ থেকে শুরু হওয়া রাজনৈতিক বন্দীদের অনশন ধর্মঘটের পরিধি বাড়ছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, অনশনে জড়িত বন্দীরা সরকারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। এই রাজনৈতিক বন্দীদের অনশন ধর্মঘট আবারও সৌদি আরব সমর্থিত বাহরাইনের রাজপরিবার এবং বিরোধীদের মধ্যে মতপার্থক্যকে সামনে এনেছে।

বাহরাইনের জনসংখ্যার অধিকাংশই শিয়া মুসলমান এবং রাজপরিবার সুন্নি মুসলিম। ২০১১ সালে সৌদি আরব আরব বসন্তের প্রভাব দমন করতে বাহরাইনে তার সৈন্য প্রেরণ করে। রয়টার্স লিখেছে, আরব বসন্তের পর থেকে বাহরাইনের সুন্নি মুসলিম শাসক আল খলিফা পরিবার এখানে ভিন্নমত দমন করে আসছে।

আরব বসন্তে বাহরাইনে শিয়া বিক্ষোভকারীরা প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসে। এর পর বন্দীদের এই ধর্মঘটকে কয়েক বছর পর আবারও একটি সংগঠিত প্রতিবাদ হিসেবে দেখা হচ্ছে। প্রতিবেশী সুন্নি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ সৌদি আরব ঐতিহাসিকভাবে বাহরাইনের রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রতি সংবেদনশীল।

শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ বাহরাইনে বহু বছর ধরে সুন্নি পরিবার আল খলিফা শাসন করে আসছে। এর আগে বাহরাইনে শিয়া বিদ্রোহীদের ইন্ধন জোগানোর অভিযোগ ওঠে ইরানের বিরুদ্ধে। ইরান একটি শিয়া মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ।

বাহরাইনের রাজধানী মানামার জাউ কারাগারে প্রায় ৮০০ বন্দী অনশন করছেন বলে মানবাধিকার সংগঠন ও বন্দীদের পরিবার জানিয়েছে। এই বন্দীরা কারাগারের খারাপ অবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। বৃহস্পতিবার বন্দীরা অনশন শেষ করার জন্য সরকারের দেওয়া কিছু প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন।

বাহরাইন ইনস্টিটিউট ফর রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসির অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর সৈয়দ আলওয়াদাই রয়টার্সকে বলেন, বন্দীদের কথোপকথন এবং বাহরাইনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি থেকে এটা স্পষ্ট যে অনশন ধর্মঘট এখনই শেষ হবে না। অনশন শেষ করতে হলে সরকারকে সততার সঙ্গে বন্দীদের উদ্বেগের দিকে নজর দিতে হবে।

‘বন্দীদের দাবি— খোলা বাতাসে থাকার সময় বাড়াতে হবে, নামাজের অনুমতি দিতে হবে, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করার নিয়ম পরিবর্তন করতে হবে এবং চিকিৎসা সুবিধা ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে’, বলেন আলওয়াদাই।

অনশন নিয়ে কী বলছে বাহরাইন সরকার?

বাহরাইনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সোমবার জানিয়েছে, তারা বন্দীদের উন্মুক্ত স্থানে থাকার সময়সীমা দুই থেকে চার ঘণ্টা করতে প্রস্তুত এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ও বাড়ানো হবে।

এ ছাড়া ফোন কথোপকথনের সময়ও পর্যালোচনার জন্য প্রস্তুত। বাহরাইন সরকার অস্বীকার করেছে যে তারা রাজনৈতিক বিরোধীদের টার্গেট করছে। সরকার বলছে, তারা জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী বন্দীদের সঙ্গে আচরণ করা হচ্ছে। কারাগারে বন্দীদের অবস্থা নিয়ে সমালোচনা প্রত্যাখ্যান করেছে সরকার।

বাহরাইন সরকার ৮০০ বন্দীর অনশন ধর্মঘটের কথাও অস্বীকার করেছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে পাঠানো এক জবাবে বাহরাইনের কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ৮০০ জন নয়, অনশনে আছেন মাত্র ১২১ থেকে ১২৪ জন বন্দী।

বাহরাইন উপসাগরীয় অঞ্চলে একমাত্র রাজতান্ত্রিক সরকার ছিল যেখানে আরব বসন্তের প্রভাব ছিল। এখানেও বিক্ষোভকারীরা রাজপরিবারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে। এই প্রতিবাদ ২০১৩ সাল পর্যন্ত কোনও না কোনও ভাবে চলতে থাকে।

এর পর সেখানকার সরকার প্রধান বিরোধী দলটি ভেঙে যায় এবং হাজার হাজার মানুষের বিরুদ্ধে মামলা হয়। শত শত মানুষের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে। অনেককে দেশ ছাড়তে হয়েছে। বাহরাইনের মানবাধিকার কর্মী মরিয়ম আল-খাজা বলেন, তার বাবা বিশিষ্ট বিরোধী দলীয় নেতা আবদুলহাদিকে অনশনের পর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) যেতে হয়েছিল।

মরিয়ম বলেন, এমনকি একজন কার্ডিওলজিস্টকেও তার বাবার চিকিৎসার জন্য যেতে দেওয়া হচ্ছে না। আহমেদ জাফর সেই বন্দীদের মধ্যে একজন, যাদের অনশন শুরু করার সময় নির্জন কারাবাসে রাখা হয়েছিল। জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর জানিয়েছে, তারা বাহরাইনের বন্দীদের অবস্থা মূল্যায়ন করবে। জাতিসংঘ বলেছে, বাহরাইনের উচিত আন্তর্জাতিক নিয়মের ভিত্তিতে বন্দীদের সঙ্গে আচরণ করা।

বাহরাইন ইনস্টিটিউট ফর রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসির মতে, সরকারের পদক্ষেপের মাত্রা আরও ভালভাবে বোঝার জন্য এই পরিসংখ্যানগুলি দেখা যেতে পারে। এখান কারাগারে মোট ৩২০০ থেকে ৩৮০০ বন্দী রয়েছে। এদের মধ্যে ১৪০০ জন রাজনৈতিক বন্দী।

বন্দীদের দাবি কী?

বাহরাইনের কারাগারে বন্দীদের বেশ কয়েকটি দাবি রয়েছে। বন্দীরা বলছেন, তাদের কাউকে কাউকে ২৩ ঘণ্টা পর্যন্ত কারাকক্ষে আটকে রাখা হয়। এর অবসান ঘটাতে হবে।

পুরানো সিস্টেমে বন্দীদের সারা দিনই সেলের বাইরে থাকার অনুমতি ছিল। এ সময় জেল প্রাঙ্গণের ফুটবল কোর্ট, লাইব্রেরি, মসজিদে গিয়ে সম্মিলিতভাবে নামাজ আদায় করতে পারতেন। বন্দীরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার অধিকারও ফিরে পেতে চান।

বন্দীদের অন্যতম দাবি, তাদের স্বাস্থ্যের প্রতি যেন কোনো অবহেলা না করা হয়। কিছু বন্দী অভিযোগ করেছেন যে কখনও কখনও তাদের এক বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এ ছাড়া ধর্মঘটে থাকা বন্দীরা এক মাসের মধ্যে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করার জন্য মাত্র আধা ঘণ্টার সময়সীমা বাতিলেও দাবি জানিয়েছেন।

যারা অনশনে রয়েছেন তাদের মধ্যে বেশ ক’জন সুপরিচিত রাজনৈতিক বন্দীর পাশাপাশি বয়স্ক এবং অসুস্থ বন্দীও রয়েছেন। বাহরাইনের ভেতরে ও বাইরে বসবাসরত অনেক অ্যাক্টিভিস্ট, মানবাধিকার কর্মী ও আলেম এই বন্দীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন।

৮৬ বছর বয়সী আয়াতুল্লাহ ঈসা কাসিম, আলী সালমান, আবদুলহাদি খাজা, হাসান মুশাহিমা, নাবিল রজব, আবদুলওয়াহাব হুসাইন, আবদুল জলিল আল-সিঙ্গেস— এদের অধিকাংশই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডভোগ করছেন। আয়াতুল্লাহ কাসিমের নাগরিকত্বও প্রত্যাহার করা হয়েছে।

এদিকে, বাহরাইনের অনেক জায়গায় অনশনে থাকা বন্দীদের দাবির সমর্থনে এবং রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ হচ্ছে। বাহরাইনের ৭৯ জন রাজনৈতিক ও মানবাধিকার কর্মী দেশটি ক্রাউন প্রিন্স ও প্রধানমন্ত্রী সালমান বিন হামাদ আল খলিফার কাছে বন্দীদের মুক্তির দাবিতে একটি যৌথ চিঠি লিখেছেন।

শেয়ার করুন