জন্মাষ্টমী : শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি

তারাপদ আচার্য্য

শুভ জন্মাষ্টমী
ফাইল ছবি

যিনি সর্বাপেক্ষা বৃহৎ, তিনিই ভগবান। বেদে তাঁর পরিচয় ব্রহ্ম। এত বড় যে তিনি আমাদের নাগালের বাইরে। আমাদের ষড় ইন্দ্রিয়, আমাদের ক্ষুদ্র মন, আমাদের সংকীর্ণ বুদ্ধি—এসবের বহু ঊর্ধ্বে তিনি। তাঁকে পাওয়া আমাদের সাধ্যের বাইরে, তবে তাঁকে পাওয়ার জন্য ভক্তের নিরন্তর আকুলতা সৃষ্টিকর্তার মনেও দোলা না দিয়ে পারে না। এ সমস্যার সমাধান করলেন তিনি নিজেই নিত্য ও অনুগ্রহ শক্তির প্রেরণায় ‘অনুগ্রহায় ভূতানাং’। কৃপা করে তিনি এলেন এই ধূলির ধরায়, আমাদের দুয়ারে। ভগবান অবতরণ করলেন মানুষের ঘরে, করুণায় বিগলিত হয়ে।

সীমাহীন ধরা দিলেন সীমানার কিনারে, মানুষরূপে, মানুষের বন্ধু হয়ে, পরম ব্রহ্ম শুদ্ধাভক্তি দেবকী ও শুদ্ধসত্য বাসুদেবের ঘরে কৃষ্ণরূপে পুত্র পরিচয়ে।

শ্রীকৃষ্ণের এই জন্মতিথি হলো জন্মাষ্টমী। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে রোহিণী নক্ষত্র যোগে কৃষ্ণ মধুরায় কংসের কারাগারে জন্ম নেন শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর এই জন্মদিনকে জন্মাষ্টমী বলা হয়।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কেন জন্মগ্রহণ করেছিলেন তার ব্যাখ্যাও তিনি গীতায়ই দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,
যদাযদাহি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।

অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্\

পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুস্কৃতাম্ ।

ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভাবমি যুগে যুগে\

—জ্ঞানযোগ ৭/৮

হে ভারত, যখনই পৃথিবীতে অধর্ম বেড়ে যায় তখন আমি অবতীর্ণ হই, অবতীর্ণ হয়ে সাধুদের রক্ষা, দুষ্টদের বিনাশ ও ধর্ম সংস্থাপন করি।

শ্রীকৃষ্ণ পৃথিবীকে কলুষমুক্ত করতে কংস, জরাসন্ধ, শিশুপালসহ বিভিন্ন অত্যাচারিত রাজাদের ধ্বংস করেন এবং ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।

পুরাণাদিতে অবতারের অসুর বিনাশের যে লীলা বর্ণনা আছে, ধর্ম সংস্থাপন বলতে শুধু তা-ই বোঝায় না। ধর্মের দুটি দিক আছে—বাহ্য বা ব্যাবহারিক ও অভ্যন্তরীণ বা আধ্যাত্মিক। শ্রীকৃষ্ণ-অবতারেরও দুটি উদ্দেশ্যের দুটি দিক হলো—অন্তর্জগতে মানবাত্মার উন্নতি সাধন ও বাহ্যজগতে মানবসমাজের রাষ্ট্রীয় বা নৈতিক পরিবর্তন সাধন। পুরাণে একে ধরাভারহরণ, অসুর-নিধনাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু এটাই শুধু শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্য নয়। বুদ্ধ, খ্রিস্ট, শ্রীচৈতন্য, শ্রীরামকৃষ্ণসহ অনেককেই অবতার বলা হয়, এসব অবতারের অসুর বিনাশ নেই, এসব অবতারের একমাত্র উদ্দেশ্য মানবাত্মাকে দিব্য প্রেম-পবিত্রতা-জ্ঞান-ভক্তির অনুপ্রেরণা দেওয়া। পক্ষান্তরে পৌরাণিক নৃসিংহাদি অবতারের অসুর বিনাশ ব্যতীত আর কিছু দেখা যায় না। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ অবতারের দুটি উদ্দেশ্যই বিদ্যমান।

দ্বাপর যুগে অসুররূপী রাজশক্তির দাপটে পৃথিবী ম্রিয়মাণ হয়ে ওঠে, ধর্ম ও ধার্মিকরা অসহায় হয়ে পড়েন। বসুমতী পরিত্রাণের জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। ব্রহ্মার পরামর্শে দেবতারা মিলে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে যান দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে। সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের যুগসন্ধিক্ষণে তাঁরা সবাই মিলে বিষ্ণুর বন্দনা করেন। স্বয়ং ব্রহ্মা মগ্ন হন কঠোর তপস্যায়। ধরণির দুঃখ-দুর্দশায় ব্যথিত হয়ে দেবতাদের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি দেবতাদের অভয়বাণী শোনান এই বলে যে তিনি অচিরেই মানবরূপে ধরাধামে অবতীর্ণ হবেন দেবকীর অষ্টম সন্তানরূপে শঙ্খ চক্র, গদাপদ্মধারী শ্রীকৃষ্ণরূপে। ভগবান বিষ্ণু দেবতাদের নির্দেশ দেন ধরাধামে তাঁর লীলার সহচর হওয়ার জন্য। বিষ্ণুর নির্দেশমতো দেবতারা তাঁদের নিজ নিজ পত্নীসহ ভগবানের কাঙ্ক্ষিত কর্মে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে যদুকুলে বিভিন্ন পরিবারে জন্ম নেন। এভাবে ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য দেবতাদের মর্ত্যলোকে অবতরণ।

শাস্ত্রমতে, ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে মানবরূপে মর্তে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব। দ্বাপর যুগে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের উদ্দেশ্যে পৃথিবীতে এসেছিলেন ভক্তের ভগবান হয়ে। পাশবিক শক্তি যখন সত্য, সুন্দর ও পবিত্রতাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছিল, তখন সেই অসুন্দরকে দমন করে মানবজাতিকে রক্ষা এবং শুভ শক্তিকে প্রতিষ্ঠার জন্য মহাবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মগ্রন্থ গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দ্বাপর যুগের সন্ধিক্ষণে বিশৃঙ্খল ও অবক্ষয়িত মূল্যবোধের পৃথিবীতে মানবপ্রেমের অমিয় বাণী প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ

শেয়ার করুন