স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তনের জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম থেকেই চেষ্টা করেছেন। তিনি কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে বিজ্ঞানভিত্তিক, কর্মমুখী যে শিক্ষাব্যবস্থার পত্তন করেছিলেন তা যদি সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন করা যেত, তাহলে বাংলাদেশের যুবসমাজের প্রভূত উন্নতি সাধিত হতো এবং বাংলাদেশও আজ উন্নত বিশ্বের কাতারে গিয়ে পৌঁছত। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাসহ বঙ্গবন্ধুর গৃহীত পদক্ষেপগুলো যখন ধ্বংস করে দেওয়া হয়, তখন শিক্ষাসংক্রান্ত আধুনিক চিন্তা অথবা বঙ্গবন্ধুর প্রবর্তিত শিক্ষাধারণা যে পরিত্যক্ত হবে, সেটা দিবালোকের মতোই সত্য। হয়েও ছিল তাই।
এরপর ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধু-তনয়া দেশরত্ন শেখ হাসিনা বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৯৬ সালে তাঁর রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত, যুগোপযোগী কর্মমুখিতার নিরিখে চিন্তা করা যে হয়নি, ইতিহাস তার প্রমাণ। এরপর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শাসন ধারাবাহিকতা পায়নি নানামুখী ষড়যন্ত্রের কারণে। ২০০৮ সালে ‘দিনবদলের সনদ’ নিয়ে আবার নির্বাচনে জয়যুক্ত হয় আওয়ামী লীগ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে যে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছিলেন, সেখানে ছিল দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রতিষ্ঠা এবং সমৃদ্ধির পথে নতুন করে পথচলার অঙ্গীকার। স্বৈরশাসন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া ও আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের মাধ্যমে বিশ্বসভায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠায় ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সময়ের মধ্যে ইতিবাচকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় এ দেশের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে। ২০০৮ সালে নির্বাচনের প্রাক্কালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন ‘দিনবদলের সনদ’ নামের নির্বাচনী ইশতেহার। দিনবদলের অঙ্গীকারে দীর্ঘ মেয়াদে প্রেক্ষিত-পরিকল্পনা বাস্তবায়নের রূপকল্প ২০২১-এর পথ ধরে অর্জিত হয় ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’।
বাংলাদেশের মানুষের কাছে এটি হয়ে ওঠে দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ। অকল্পনীয় দ্রুততায় বিস্তার ঘটে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার। চিরদিন ‘ওপর থেকে নিচ’ এই পদ্ধতিতে উন্নয়ন পরিকল্পনা হয়েছে। এই ধারণা এ সময় সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়। সর্বাগ্রে গ্রামীণ জনগণকে ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে তথ্যসেবা প্রদান শুরু হয়।
ক্রমেই ডিজিটাল সেবা বিস্তার লাভ করে সমগ্র সেক্টরে। এটি যেন সাধারণ মানুষ কল্পনাও করতে পারেনি এবং তারা অনিবার্যভাবে উন্নয়নের গতিধারার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। একটি ক্ষুদ্র উদাহরণ দেওয়া যাক। আগে ঈদের সময় রিকশাওয়ালা অথবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ঢাকা বা বড় শহরে জীবিকা অর্জন করে বাড়ি ফেরার সময় মলম পার্টির খপ্পরে পড়ে টাকা-পয়সা হারিয়ে রাস্তাঘাটে অচেতন হয়ে পড়তেন। এটি ছিল প্রাত্যহিক সংবাদের বিষয়। এখন এই সংবাদ অতীত হয়ে গেছে, কখনো এই সংবাদ বাংলাদেশে আর হবে না। কারণ রিকশাওয়ালা বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ঈদের সময় শহর থেকে গ্রামে যাওয়ার আগেই টাকা বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যাংক বা ট্রান্সফার পদ্ধতিতে গ্রামে স্ত্রী বা নিকটাত্মীয়ের কাছে পাঠিয়ে দেন। ঈদের সময় তাঁরা উপার্জিত অর্থ সঙ্গে বহন করেন না। আর তাই মলম পার্টিও তাদের ধরে না। এ ছোট্ট উদাহরণটি আসলে বড় পরিবর্তনের একটি সামান্য দৃষ্টান্ত মাত্র। আসলে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৃহত্তর সামাজিক নিরাপত্তাবলয় কর্মসূচি এবং বিস্তৃত অবকাঠামো বিনির্মাণ। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে স্থির লক্ষ্যে এবং সেটি হলো উন্নত বিশ্বে পৌঁছার প্রত্যয়ে।
২০১৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ, ২০৪১ সালে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ এবং নিরাপদ বদ্বীপ পরিকল্পনার রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে। উন্নত বাংলাদেশের অভিযাত্রায় প্রথম ধাপ হিসেবে এর মধ্যেই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে। ২০১৮ সালে নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিজয়ের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন ডা. দীপু মনি এমপি এবং শিক্ষা উপমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন মহিবুল হাসান চৌধুরী এমপি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করে তাঁরা গতানুগতিক শিক্ষার খোলনলচে পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করেন, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর চেতনায় যে আধুনিক শিক্ষা ও কর্মমুখী শিক্ষার বিষয়টি ছিল, তা বাস্তবে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে মনোনিবেশ করেন। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮ সালকে বিবেচনায় রেখে তাঁরা যে কাজগুলো সম্পন্ন করেন তার একটা পরিসংখ্যান প্রদান করা যেতে পারে। যেমন—সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয় ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ছিল ১২ হাজার ৭০০টি। এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০২০ সালে হয় ২০ হাজার ৮৪৯টি। সরকারি ও বেসরকারি কলেজের সংখ্যা তিন হাজার ১৯৭ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয় চার হাজার ৬৯৯। কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক দৃষ্টি প্রদান করার কারণে ২০০৬ সালে সরকারি-বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেখানে ছিল তিন হাজার ৫৫৩, সেখানে ২০২০ সালে তার সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজার ৬৮৪। এই সংখ্যা এতটা বৃদ্ধি পায় তার কারণ, সরকার কারিগরি শিক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় এটিকে যুবশক্তির কর্মজগতে প্রবেশের প্রকৃত শিক্ষা বলে মনে করে। এরপর সরকারের আর্থিক প্রণোদনা পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩২ থেকে বেড়ে এখন হয়েছে ৫৪ আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৫১ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৭।
জেলায় জেলায় প্রণোদিত বিশ্ববিদ্যালয় করার ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে কৃষি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি বেশি দেখা যাচ্ছে। এর কারণ কৃষি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তির দিক থেকে এগিয়ে যেতে পারলে দেশ সহজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে। এ ছাড়া সরকারি ও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও সরকার উদ্যোগী হয়েছে। তাই ২০০৬ সালে যেখানে সরকারি ও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ছিল হাতে গোনা, ২০২০ সালে সেটা দাঁড়িয়েছে ১০৬-এ। আর সরকারি-বেসরকারি নার্সিং ইনস্টিটিউটও ৫০ থেকে বেড়েছে এবং তা বেশ কয়েক গুণ। আজ সরকারি-বেসরকারি নার্সিং ইনস্টিটিউটের সংখ্যা ৩৯০-এর কাছাকাছি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই উদ্যোগগুলো দৃশ্যমান হয়েছে, তার কারণ ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে অঙ্গীকারগুলো শুধু প্রদান করেই প্রশান্তি মেলেনি, যোগ্য শিক্ষা-নেতৃত্ব তা বাস্তবায়িত করেছেন।
নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নের বাইরে এবং গত প্রায় দুই বছরে সরকার করোনা মহামারির অভিঘাত মোকাবেলার জন্য ব্যাপকভাবে কর্মরত ছিল। ছাত্র-ছাত্রীদের যথাসময়ে এবং মহামারির হাত থেকে বাঁচানোর চ্যালেঞ্জ শিক্ষা মন্ত্রণালয় গ্রহণ করে। করোনা মহামারিকালে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে, এমনটা মনে করা হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের ডিজিটাল পদ্ধতি কার্যকর থাকায় করোনার অভিঘাত ব্যাপকভাবে শিক্ষাক্ষেত্রকে বিপর্যস্ত করতে পারেনি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে তার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করার মাধ্যমে বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়া অব্যাহত রাখে। করোনাকালেও ডিজিটাল পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণ করতে দেখা গেছে। আর তাই যে হারে সেশনজট হওয়ার কথা ছিল সে হারে হয়নি। অভিজ্ঞতা বলে, সামরিক স্বৈরাচারের শাসনকালে দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যাপকভাবে সেশনজট হয়েছিল। করোনাকালে সে তুলনায় সেশনজট হয়নি বললেই চলে। এরই মধ্যে বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় সেই সেশনজট কাটিয়ে ওঠার দ্বারপ্রান্তে আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রায় সবই সেশনজট কাটিয়ে উঠতে পেরেছে।
ওপরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিষয়ক কিছু তথ্য-উপাত্ত হাজির করা হলো বটে, কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়েও হিসাবটি একই। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নন-রেজিস্ট্রার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন ইত্যাদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে ৩৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয় করেছিলেন। আজ এর সংখ্যা ৬৬ হাজারেরও বেশি। উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে তিন হাজার ৬৬২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু যে কয়টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারি করেছিলেন, তারপর কার্যত আর কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি করা হয়নি। ২০০৬ সালের পর মূলত ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা এতটা বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি সরকার কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়ের অনুমতিও দিয়েছে। ২০০৬ সালে যেখানে দুই হাজার ২৫৩টি কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয় ছিল, সেখানে কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ৯৫০টি। ২০১৮ সালের পর বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে যে নীরব বিপ্লবের সূচনা ঘটেছে এ লেখায় আজ পরিমাণগত একটি বর্ণনা দেওয়া হলো। গুণগত পরিবর্তন বিষয়ে ভবিষ্যতে আলোচনা করা যাবে।
লেখক : উপাচার্য
নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ