প্রয়োজন স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থা

মাছুম বিল্লাহ

সরকার শিক্ষাব্যবস্থার রূপান্তর ঘটাচ্ছে। কারণ প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা বৈশ্বিক রূপান্তরের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। এ লক্ষ্যে প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয়েছে। ২০২৫ সাল নাগাদ প্রাথমিক ও পুরো মাধ্যমিকে তা বাস্তবায়ন করা হবে।

আমাদের শিক্ষার্থীরা আগে বেশির ভাগ মুখস্থ করত, কেউ বুঝে আর কেউ না বুঝে, যে জ্ঞান তারা বাস্তবজীবনে প্রয়োগ করতে পারত না। তাই নতুন কারিকুলামে যা করা হয়েছে সেটি হচ্ছে শিক্ষার্থীরা বেশির ভাগ বিষয়ই আনন্দের মাধ্যমে শিখবে, করতে করতে শিখবে, খেলতে খেলতে শিখবে, শ্রেণিকক্ষের বাইরে গিয়ে শিখবে। অর্থাৎ বাস্তবজীবন থেকে শিখবে। প্রচলিত পদ্ধতির পরীক্ষাও আর থাকছে না।

universel cardiac hospital

তারা যা কিছু করবে শিক্ষকরা, সহপাঠীরা, অভিভাবকরা তাদের অবলোকন করবেন এবং সেই অনুযায়ী গ্রেডিং বা র‌্যাংকিং করবেন, কতটা বুঝতে পেরেছে, কতটা উন্নয়ন দরকার ইত্যাদি সূচক দিয়ে। এগুলো সবই স্মার্ট শিক্ষা পদ্ধতির নমুনা। আগে একজন শিক্ষার্থী তিন ঘণ্টার পরীক্ষায় যা প্রকাশ করতে পারত সেটিই হতো তার গ্রেডিং, তার সামনে যাওয়ার পথ। অথচ এই তিন ঘণ্টার পরীক্ষায় জীবনের অনেক কিছুই প্রকাশ করা যায় না।

যেমন—একজন শিক্ষার্থী ভালো বক্তা বা ভালো গায়ক বা ভালো সংগঠক কিংবা একজন ভালো নেতা—এ সব কিছুই সেখানে প্রকাশ পায় না। ফলে তার অনেক গুণেরই মূল্যায়ন হতো না। এসব বিষয় তার তিন ঘণ্টার পরীক্ষায় উঠে আসে না। অথচ এগুলো সবই শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। তাই বর্তমান সরকার একজন শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত গুণাবলি বের করে আনা এবং সেটি তার জীবনে কাজে লাগানোর পদ্ধতি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে এবং কতগুলো পথ এরই মধ্যে আবিষ্কার করেছে।

শিক্ষামন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, ‘এমন গবেষণা ও উদ্ভাবনা করতে হবে, যার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি ও সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। এসব বিষয় সামনে রেখে আগামী দিনে শিক্ষা খাতে কোডিং, ডিজাইন, রোবটিকসের মতো যুগোপযুগী বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হবে। আমরা তৃতীয় শ্রেণি থেকে শিক্ষার্থীদের কোডিং শেখাব। আরেকটি পরিকল্পনা চালু করতে যাচ্ছি, সেটি হচ্ছে ছয় থেকে ১৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের কোডিং ও ডিজাইন শেখানো হবে। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আর ধাক্কা খাবে না। তারা স্কুল থেকেই তৈরি হয়ে আসবে। আমরা চাই প্রতিটি পর্যায়ে বয়স অনুযায়ী সব শিক্ষার্থী যত বিষয়ই পড়ুক না কেন তারা ভাষা, আইসিটি ও সফট স্কিল শিখবে। শিক্ষার্থীরা উদ্যোক্তা হতে শিখবে, মূল্যবোধ শিখবে।’ এখান থেকে আমরা স্মার্ট শিক্ষা কী তার ধারণা পাই। আমরা বাস্তবজীবনে দেখতে পাই যে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার পরও বহু শিক্ষার্থী বেকার জীবন যাপন করে অর্থাৎ অর্জিত জ্ঞান বা দক্ষতা তারা কাজে লাগাতে পারছে না। তাদের দরকার স্মার্ট হওয়া। যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দক্ষতা অর্জন করা। যে দক্ষতা তাদের জীবনে প্রত্যক্ষভাবে কাজে লাগবে। তিনি আরো বলেন, ‘প্রযুক্তির উন্নয়ন একদিকে যেমন জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়ে দিচ্ছে, অন্যদিকে এর অপব্যবহারে বিভাজন ও সহিংসতা ছড়াচ্ছে।’ তাই তিনি প্রযুক্তি দিয়ে জীবন পরিচালিত না করে, মানবিক মূল্যবোধ দিয়েই প্রযুক্তিকে পরিচালনা করতে শিক্ষার্থীদের প্রতি আহবান জানান। অত্যন্ত মূল্যবান কথা বলেছেন মাননীয় মন্ত্রী। মানুষ দক্ষতা অর্জন করতে গিয়ে আবার যন্ত্র হয়ে না যায়। মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ না হলে সেই শিক্ষার্থী নিজের, পরিবারের, সমাজের এবং দেশের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ হতে পারবে না। কাজেই স্মার্ট শিক্ষার ধারণা কিন্তু ব্যাপক।

শিক্ষামন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুকন্যা নির্দেশনা দিয়েছেন, স্বপ্ন দেখিয়েছেন, আমরা ২০৪১ সালের স্বপ্ন দেখছি। ২০০৮ সালে তিনি বলেছিলেন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়বেন। ২০২২ সালে এসে ডিজিটাল বাংলাদেশ পেয়ে গেছি। ডিজিটাল বাংলাদেশকে তিনি উদ্ভাবনীর বাংলাদেশ তৈরি করে একটা স্মার্ট বাংলাদেশ করবেন।’ এর ফলে আমরা সব দিক থেকে চৌকস হব। আমাদের শিক্ষা হবে স্মার্ট। এ সব কিছুর মধ্য দিয়ে আমরা একটি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ব। সেই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে সবার আগে শিক্ষাটাকে স্মার্ট হতে হবে। শিক্ষাকে স্মার্ট করার জন্য আমরা কয়েক বছর ধরে নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছি। ঠিক যেভাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন শিক্ষাকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং তিনি যেভাবে চিন্তা করেছিলেন তা অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে সার্বিক দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, শিক্ষানীতি তৈরি করে দিয়েছেন।

স্বাধীন-সার্বভৌম একটি দেশের উপযোগী করে তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তার সব সম্ভাবনাকে বিকশিত করতে যে রকম শিক্ষাব্যবস্থা করা দরকার, যেটি বঙ্গবন্ধুর ভাষায় কেরানি পয়দা করার শিক্ষাব্যবস্থা, সেটি নয়। একটি সাধারণ দেশের উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকন্যা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। সে জন্য বিভিন্ন ধরনের নীতিমালা করা হয়েছে। উচ্চশিক্ষায় ২০৩০ সাল পর্যন্ত যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, আমরা সেগুলো অনুসরণ করার চেষ্টা করছি। এগুলোর সার্বিক রূপই হচ্ছে স্মার্ট শিক্ষা।

আমরা এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কথা বলছি। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সফল অংশীদার হওয়ার সম্ভাবনার দিকগুলো আছে, একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জও আছে। আমাদের এসব অর্জন করতে গেলে পথে অনেক বাধা-প্রতিবন্ধকতা আছে। বিশেষ করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সফল অংশীদার হওয়ার ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেগুলো মোকাবেলা করতে নিজেদের প্রস্তুত হতে হবে। সেই প্রস্তুতির ক্ষেত্রটা হলো শিক্ষা। প্রচলিত শিক্ষার দ্বারা সেটি করা সম্ভব নয়। দরকার আধুনিক শিক্ষা, দরকার ডিজিটাল শিক্ষা, প্রয়োজন স্মার্ট শিক্ষা। কর্মসংস্থানের কথা চিন্তা করে ১২টি বিষয়ে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা চালু করতে যাচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।

স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে শিক্ষকরা বড় ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারেন। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা বাস্তবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসে শিক্ষকরা আগ্রহ প্রকাশ করেন না। শিক্ষকদের এই অনাগ্রহের কারণে একটি জাতি পিছিয়ে পড়তে পারে। তাই আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তিমূলক শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের যুক্ত করে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।

স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা—সব স্তরে স্মার্ট শিক্ষাক্রম অপরিহার্য। শিক্ষকদের তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষাক্রমে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ের পরিধি বাড়াতে হবে। জনগণকে তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি সমাজে মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। বর্তমান সরকার বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে এ বিষয়ে এগিয়ে আসা প্রয়োজন, তাহলে আমরা এ ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে পারব। ডিজিটাল বাংলাদেশকে প্রধানমন্ত্রী উদ্ভাবনীর বাংলাদেশ তৈরি করে একটা স্মার্ট বাংলাদেশ করবেন। এর ফলে আমরা সব দিক থেকে চৌকস হব। আমাদের শিক্ষা হবে স্মার্ট, অর্থনীতি হবে স্মার্ট, আমাদের গভর্ন্যান্স হবে স্মার্ট, ব্যবসা-বাণিজ্য হবে স্মার্ট। এ সব কিছুর মধ্য দিয়ে আমরা একটি স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরি করব।

প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয়েছে, সেটি এরই মধ্যে চালু হয়েছে। ২০২৫ সাল নাগাদ প্রাথমিক ও পুরো মাধ্যমিকে এটি বাস্তবায়িত হবে। উচ্চ মাধ্যমিকে ২০২৭ সাল নাগাদ বাস্তবায়ন হবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা আগে মুখস্থ করত, আত্মস্থ করতে পারত না। এখন আনন্দের মধ্য দিয়ে শেখার পথ তৈরি করে দিয়েছে নতুন কারিকুলাম, অভিজ্ঞতাভিত্তিক সক্রিয় শিখন কারিকুলাম। শিক্ষার্থীরা যে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করবে, বাস্তবে তা প্রয়োগ করতে শিখবে। এটিই শিক্ষার স্মার্টনেস। সরকার ছয় থেকে ১৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের কোডিং, ডিজাইন শেখানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের স্মার্টনেসের দিকে ধাবিত করার পথ তৈরি করছে। তারা ভাষা, আইসিটি, সফট স্কিল শিখবে, বিভিন্ন দক্ষতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা শিখবে। উদ্যোক্তা হতে শিখবে। দেশটাকে পুরোপুরি পাল্টে ফেলে নতুন যুগের সূচনা করবে। তাই বর্তমান সরকার অত্যন্ত কার্যকর একটি স্লোগান সামনে নিয়ে এসেছে, যেখানে আমাদের সবাইকে শামিল হতে হবে।

লেখক : শিক্ষা গবেষক ও কান্ট্রি ডিরেক্টর ভলান্টিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর বাংলাদেশ

masumbillah65@gmail.com

শেয়ার করুন