নির্বাচন মাথায় রেখেই সব কাজ করতে হবে

মোনায়েম সরকার

মোনায়েম সরকার
মোনায়েম সরকার। ফাইল ছবি

গত বৃহস্পতিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) সচিবালয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় তিনটি পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়ার ঘোষণা দেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি জানান, ওইদিন থেকেই খুচরা পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের দাম হবে সর্বোচ্চ ১২ টাকা, প্রতি কেজি আলু ৩৬ এবং দেশি পেঁয়াজ ৬৫ টাকা। তবে পরের দিন শুক্রবার রাজধানীর ৯টি খুচরা বাজার ঘুরে সরকারি নির্দেশনার প্রতিফলনের চিত্র দেখতে পাননি গণমাধ্যমকর্মীরা। এসব বাজারের কোনোটিতে পণ্য তিনটি নির্ধারিত দরে বিক্রি হয়নি। দেশের অন্য স্থানেও দাম কমেনি।

দাম নির্ধারণের পাশাপাশি সরকার কঠোরভাবে বাজার তদারকির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ভোক্তা অধিদপ্তর, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবাই বাজারে তদারকি করবে বলা হলেও শুক্রবার ভোক্তা অধিদপ্তর ছাড়া কেউ বাজারে নামেনি বলে পত্রিকায় খবর ছাপা হয়েছে।

ভোক্তারা বলছেন, সরকার দাম বেঁধে দিয়েই দায় সারছে। তারা প্রতিদিন ঠকেই যাচ্ছেন। সরকারের নির্দেশনা মানছে না কেউ। শুধু মুখে না বলে সরকারের উচিত প্রতিটি ধাপে পণ্যের মজুত পর্যালোচনা করা এবং বাজারে যথাযথ সরবরাহ নিশ্চিত করা। সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে মাঠে না নামালে অবস্থার পরিবর্তন হবে না।

অন্যদিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট তদারকি সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, নির্দেশনা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দাম কার্যকর করা কঠিন। কারণ, খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে নতুন দরের পণ্য পৌঁছাতে কিছুটা সময় লাগে। তাই তারা এখন উৎপাদন ও মজুত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং এসব পর্যায়ে নির্ধারিত দাম কার্যকরের বিষয়ে বেশি মনোযোগী। এসব স্তরে দাম স্বাভাবিক হলে খুচরায় নির্ধারিত দর কার্যকর হবে বলে মনে করেন তারা।

ক্রেতারা স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াতে পারেন, কমাতে পারেন না। বাজারে নিয়মিত তদারকি করতে হবে। জিনিসের এত দাম, আর কুলাতে পারি না। একের পর এক জিনিসের দাম বাড়ছে। শক্ত হাতে বাজার তদারকি না করে শুধু ঘোষণা দিলে দাম কমবে না।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, কয়েকদিন ধরেই বাজারে কারসাজি চলছে। তাই দর বেঁধে দেওয়াকে স্বাগত জানাই। কিন্তু বাজারে সেই চিত্র দেখা যায়নি। দর নির্ধারণ করে দায় সারলে হবে না। মাঠ পর্যায়ে এটি কার্যকর করতে হবে। ভোক্তা অধিদপ্তরের পাশাপাশি জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং কৃষি, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকে নিয়ে সমন্বিত বাজার তদারকি নিশ্চিত করতে হবে। ব্যবসায়ীরা বাজার তদারকিকে হাস্যকর করার জন্য নানা ফন্দি-ফিকির করতে চাইবেন। এজন্য আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে যেসব পণ্য নিয়ে কারসাজি হয়, সেগুলো দ্রুত আমদানি করতে হবে।

নির্বাচন সামনে রেখে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বাড়বে। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে স্বভাবতই মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে। মানুষের আয়রোজগার তো হুটহাট করে বাড়ে না। আয় না বাড়লে ব্যয় বাড়ার সঙ্গে সমন্বয় করতে পারা যায় না। সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা মানুষ তো নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়েই বিচার করবে। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের খাওয়া-পরার ঘাটতি হলে মানুষ উন্নয়নের গল্প শুনে ভোট দেবে কি না, তা ভাবতে হবে গুরুত্ব দিয়েই। মানুষের কষ্ট দূর করার কথা সরকারকে গুরুত্ব দিয়েই ভাবতে হবে।

দুই.
স্থানীয় সরকার দিবস-২০২৩ উদযাপন উপলক্ষে গত ১৪ সেপ্টেম্বর গণভবনে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে ওই অনুষ্ঠানে সারাদেশের ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, পৌরসভা মেয়র, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য, সিটি করপোরেশনের মেয়র ও ওয়ার্ড কাউন্সিলররা এতে অংশ নেন।

সভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মানুষ যেন ভোট দিতে পারে, সেই পরিবেশ তৈরি করতে সারাদেশের স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আপনারা তৃণমূলের জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি। আপনারা যথাযথ দায়িত্ব পালন করে মানুষের আস্থা অর্জন করে এগিয়ে যাবেন। মানুষ যেন আবার ভোট দিতে পারে, সেই পরিবেশ আপনারা তৈরি করবেন। আপনারাই সেটা পারবেন। আমরাও চাই- যে উন্নয়নটা হচ্ছে, তা যেন অব্যাহত থাকে। কেউ যেন দেশকে পিছিয়ে দিতে না পারে। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আমরা আরও উজ্জ্বল করে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াব।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক ধারা ছিল বলেই একেবারে গ্রাম পর্যন্ত উন্নয়ন করা সম্ভব হয়েছে। আবারো সুযোগ পেলে প্রতিটি গ্রামকে শহরের মতো গড়ে তোলা হবে। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর স্থানীয় সরকারকে যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ দিয়ে তৃণমূলে উন্নয়নের সুযোগ করে দিয়েছি। কষ্টের এ ফসল যেন কেউ নষ্ট করতে না পারে। অগ্রযাত্রা যেন অব্যাহত থাকে, সেভাবেই কাজ করতে হবে সবাইকে। স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়নি, ব্যর্থ হতেও আমরা দেব না। তিনি বলেন, আমি জানি, এখনো অনেক গ্রামে কাঁচা রাস্তা আছে। আবারো জনগণের সেবা করার সুযোগ পেলে সেগুলোও করে দেব। কারণ, প্রত্যেক গ্রাম শহরের মতো করে গড়ে উঠবে।

সারাদেশ থেকে আসা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ডেঙ্গু প্রতিরোধে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ডেঙ্গু ও মশার হাত থেকে বাঁচতে হলে মশারি ব্যবহার করতে হবে। আশপাশের ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখতে হবে। মশা মেরে শেষ করা যাবে না; নিজেরাই সচেতন হতে হবে। এজন্য বাড়ির চারপাশ যেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে সেজন্য সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।

খাদ্য উৎপাদনের গুরুত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুধু বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করাই নয়- এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে। সব জায়গায় ফসল ফলাবেন। তাতে আপনারাই লাভবান হবেন। আমিও লাভবান হয়েছি। আমার মা-বাবার যে জমি ছিল, তার কিছু অংশ চাষ করেছিলাম। খরচ বাদে ২ লাখ ২৮ হাজার টাকা আয় হয়েছে। কাজেই নিজেরা ফসল ফলাব, নিজেরা খাব; কারও কাছে হাত পাততে হবে না। আমি অনুরোধ করব, আপনারা নিজেদের জমি চাষ করেন, গাছ লাগান, বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৮ জন কৃষককে গুলি করে হত্যা করেছিল খালেদা জিয়া। আজ কৃষকের ঘরে সার পৌঁছে যায়। তাদের কৃষি উপকরণ কার্ড দিয়েছি। এটা দিয়ে কৃষি উপকরণ কিনতে পারে। ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে। এর মাধ্যমে ভর্তুকির টাকা সরাসরি কৃষকের কাছে পৌঁছে যায়। জেলেদের ৪০ কেজি করে চাল দেই। তিনি বলেন, এখন শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ পায়। শিক্ষার্থীদের বই, বৃত্তি, উপবৃত্তি দিচ্ছি।
ডিজিটাল সেন্টার করে দিচ্ছি।

ইনকিউবেটর, হাইটেক পার্ক করে দিয়েছি। আজকের বাংলাদেশ ডিজিটাল বাংলাদেশ। ৭৩ শতাংশ লোক ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ঘরে ঘরে মোবাইল ফোন। সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজ করি। কোনো মানুষ দরিদ্র থাকবে না। নানাভাবে তাদের এগিয়ে নেওয়ার কাজ করছি। প্রতিবন্ধী, বয়স্ক, স্বামী পরিত্যক্তাদের ভাতা দিচ্ছি। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের স্বীকৃতি ও তাদের ভাতা দিচ্ছি। ৫ কোটি মানুষের পারিবারিক কার্ড করে দিয়েছি। এটা দিয়ে স্বল্পমূল্যে প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারে।

শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতার আদর্শ নিয়ে সংবিধানে বর্ণিত পন্থায় আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, পৌর ও সিটি করপোরেশন আইন করে আমরা এগুলো নিয়ে যাচ্ছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি, ঘরে বসে চাকরির আবেদনসহ যাবতীয় সেবার কাজ করতে পারে মানুষ। অনলাইনে কেনাবেচাসহ সবকিছু হচ্ছে। আমরা তরুণ-তরুণীদের ফ্রিল্যান্সিং শেখাচ্ছি। তারা এই ট্রেনিং নিয়ে বিদেশেও কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। তিনি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ করার সঙ্গে সঙ্গে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কাজ করছি। আমাদের যা সম্পদ আছে, তা নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। সেভাবে কাজ করছি। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছি এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আছে বলেই এ কাজ করে যেতে পারছি। ৭৬৭ ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স করে দিয়েছি। ১১৯১টি সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করেছি। গ্রাম পর্যায়ে অসংখ্য রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, কালভার্ট করে দিয়েছি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা দিয়ে গেছেন জাতির পিতা। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষকে ক্ষমতায়ন করে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। তখনই এলো আঘাত। জাতির পিতাকে সপরিবারে শাহাদতবরণ করতে হয়। হারিয়েছিলাম বাবা-মা ভাইবোন। পেয়েছি বিশাল জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশের মানুষই আমার আপনজন। তারাই আমার সব শক্তি।

শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি-জামায়াত সারাদেশে ৫০০ জায়গায় বোমা হামলা করেছিল। আমি ৫৬০টি মসজিদ নির্মাণ করছি। শুধু মসজিদই নয়, মন্দির ও প্যাগোডা- যখন যেখানে যেটা দরকার করে দিয়েছি। সবাই এক কাতারে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। একসঙ্গে থাকব। তৃণমূলের জন্য পল্লীসঞ্চয় ব্যাংক এবং প্রবাসীদের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক করে দিয়েছি। তারা তো এ ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু এখনো দালালের খপ্পরে পড়ে বিদেশে গিয়ে বিপদে পড়ে। এগুলো খেয়াল রাখবেন। পাশাপাশি মাদকের বিরুদ্ধে আপনাদের দাঁড়াতে হবে। কেউ যাতে মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের না জড়ায়, সেটা আপনাদের দেখতে হবে।

শেখ হাসিনা বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছি। ৩০ ধরনের ওষুধ দেই। চিকিৎসা ও ওষুধ মানুষ পায় কি না, একটু দেখবেন। নজর রাখবেন।

প্রধানমন্ত্রী যেসব তথ্য দিয়েছেন, সেগুলো স্থানীয় পর্যায়ে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নিজ নিজ এলাকায় ফিরে গেছেন। দেখার বিষয় এই বক্তব্যগুলো কতটুকু প্রচার হয়। প্রধানমন্ত্রীর সামনে যে অঙ্গীকার সবাই করেন, তা কি যথাযথভাবে পালন করা হয়?

সরকারের জনকল্যাণমূলক কাজের পক্ষে প্রচার-প্রচারণা কম। দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা নিজেদের আখের গোছানোর ব্যাপারে যতটা তৎপর, কলহ-বিবাদে যতটা উৎসাহী সরকারের সাফল্য প্রচারে তারা ততটাই বিমুখ। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

নির্বাচনে জিততে হলে আওয়ামী লীগ সংগঠনের মধ্যে একটি বড় ঝাঁকুনি দিতে হবে। বিরোধ-কোন্দলে না জড়িয়ে নৌকা মার্কার প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা একজোট হয়ে প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিলে সুফল ঘরে তোলা কঠিন হবে না। মানুষের সঙ্গে দূরত্ব না বাড়িয়ে নৈকট্য বাড়ানোই হবে একমাত্র কাজ।

১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর।

শেয়ার করুন