শিক্ষা কারিকুলাম ফলকেন্দ্রিক হওয়া বাঞ্ছনীয়

ড. নিয়াজ আহম্মেদ

ড. নিয়াজ আহম্মেদ

শিক্ষা কারিকুলামের ধারণা আমাদের দেশে বেশ নতুন। একসময় আমরা শুধু সিলেবাস সম্পর্কে পরিচিত ছিলাম। শিক্ষাবর্ষের শুরুতে আমাদের সিলেবাস ধরিয়ে দেওয়া হতো, যার মধ্যে থাকত কী কী বিষয় পড়ানো হবে এবং কতগুলো বইয়ের নাম। এর বাইরে কিছুই ছিল না।

কেন সংশ্লিষ্ট কোর্সটি পড়ানো হবে এবং পড়ে আমার কী জ্ঞান অর্জিত হবে বা লাভ হবে এবং ওই জ্ঞান কোথায় কিভাবে কাজে লাগাতে পারব, তা আমাদের জানা ছিল না। এখন আমরা সিলেবাস না বলে কারিকুলাম বলছি, যার মূল বিষয়বস্তু একজন শিক্ষার্থী কোনো একটি বিষয় ও কোর্স কেন পড়বে এবং পড়ার উদ্দেশ্যসহ কোন পদ্ধতি ও কৌশলে মূল্যায়ন করা হবে তার আদ্যোপান্ত জানা। এর অন্যতম লক্ষ্য কোনো একটি বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থীকে আগেই অবহিত করা। কিন্তু সেই কারিকুলাম যদি ফলকেন্দ্রিক না হয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা বেশি লাভবান হয় না।

আমাদের শিক্ষা, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা আজ কারিকুলামকেন্দ্রিক। একটি সুন্দর কারিকুলাম একজন শিক্ষার্থীকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহায়তা করে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অভিভাবক ও অন্যদের কতগুলো বিষয় মনে রাখতে হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের অনেক গলদ রয়েছে, সেগুলোর উত্তরণ না হলে কারিকুলাম সফল হওয়া অনেকটা অসম্ভব।

আমরা এখনো শিক্ষা কারিকুলামে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের পরিবর্তে মুখস্থ বিদ্যার প্রতি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। আমাদের কাছে স্মরণশক্তিভিত্তিক দক্ষতা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। এমনভাবে পদ্ধতি তৈরি করছি, যেন মুখস্থ একটি বড় অংশ হয়। আমাদের শিক্ষা অনেকটা মেধাক্রমভিত্তিক। ধরুন, শিক্ষার্থী এ প্লাস পেল, এর অর্থ সে মেধাবী। মেধাভিত্তিক শিক্ষা শিক্ষার্থীকে নির্দিষ্ট করে দেয়। কোনো কারণে দ্বিতীয়বার এ প্লাস না পেলে তার মধ্যে হতাশা কাজ করে। কিন্তু শিক্ষা যদি বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ক্ষেত্র হতো, তাহলে সে যে বিষয়ে পারদর্শী, তাকে সেই বিষয়ে পড়তে আমরা উৎসাহিত করতাম।

পড়ার বিষয় জ্ঞানের একটি শাখা মাত্র। সার্টিফিকেট ও ট্রান্সক্রিপ্ট নিজেকে পরিমাপের একটি মাধ্যম মাত্র। কিন্তু ভালো মার্কস থাকার পরও যদি আমার দক্ষতা না থাকে, তাহলে সেই শিক্ষার কোনো মূল্য থাকে না। পরিবারে সব সন্তান একই ধরনের মেধা ও যোগ্যতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। সবার সামর্থ্য ও দক্ষতা এক নয়। কাজেই প্রত্যেকের দক্ষতা অনুযায়ী বিষয় নির্বাচনের পরামর্শ দেওয়া দরকার। সন্তানের হয়তো ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছা নেই, কিন্তু আমি যদি জোর করে তাকে তা বানাতে চাই, তাহলে হিতে বিপরীত হয়। তার হয়তো দর্শনশাস্ত্রে পড়ার ইচ্ছা। তাকে তা পড়তে না দেওয়ার অর্থ তার ইচ্ছাকে অবদমন করা। তার সৃষ্টিশীলতাকে অবদমন করা। কাজেই বিষয় নির্বাচনে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সচেতন হতে হবে। কেননা বিষয় নির্বাচনের ওপর তার সামর্থ্য ও দক্ষতা বিকাশের বিষয় জড়িত। কোনো কারণে শিক্ষার্থীর পছন্দকে গুরুত্ব না দিলে তার লেখাপড়ায় যেমন সমস্যা হয়, তেমনি তার মানসিক অবস্থাও খারাপের দিকে যেতে পারে। শিক্ষাকে আমরা একটি প্রতিযোগিতা হিসেবে সব সময় বিবেচনা করি। প্রতিযোগিতা না থাকলে শেখার আগ্রহ কেন থাকবে? কিন্তু আমরা শিক্ষাকে সহযোগিতাও ভাবতে পারি। আমরা মেধা পরিমাপকের যন্ত্রে পরিণত হয়েছি। কিন্তু মেধার ফল কী এবং সেই ফল কিভাবে কাজে লাগানো যায়, সে ব্যাপারে আমাদের মনোযোগ কম। আমরা গণহারে গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছি। কিন্তু এর ফল ও কাজে লাগানোর দক্ষতাসম্পন্ন হিসেবে তাদের তৈরি করছি কি? একজন গ্র্যাজুয়েট কোথায় তার দক্ষতা কাজে লাগাবে, তার ক্ষেত্রও আমরা জানি না। চতুর্থ শিল্প বিল্পবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের তাই ফলকেন্দ্রিক কারিকুলামের ওপর জোর দিতে হবে।

ফলকেন্দ্রিক কারিকুলাম উন্নয়নে আমাদের কতগুলো বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমে দেখতে হবে আমাদের কারিকুলামে একজন শিক্ষার্থী কোনো বিষয়ে জ্ঞানলাভ করার পর সে বিষয় সম্পর্কে তার ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা তৈরি হয়েছে কি না। একটি বিষয় পড়ার পর যদি সে বিষয়ে তার ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা তৈরি হয়, তাহলে তার সামর্থ্য বৃদ্ধি পাবে। সঙ্গে সঙ্গে তার সংশ্লিষ্ট বিষয় বর্ণনা করার ক্ষমতাও তৈরি হতে হবে। যে বিষয়টি সে পড়বে, তা চিহ্নিত করার সামর্থ্য থাকতে হবে। জ্ঞান অর্জন করলেই হবে না, সেই জ্ঞান বিশ্লেষণের ক্ষমতাও তৈরি হতে হবে। বিশ্লেষণ তার সৃজনশীলতাকে বৃদ্ধি করবে এবং সে জ্ঞান সৃষ্টিতে এবং সেই জ্ঞান কাজে লাগাতে পারবে। আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো জ্ঞান প্রয়োগ করার ক্ষমতা। জ্ঞান অর্জন করা কঠিন নয়, কিন্তু জ্ঞান বাস্তবে কোথায় কিভাবে কাজে লাগানো যায় তার সামর্থ্য থাকতে হবে। একটি বিষয়ে পড়াশোনা করে একজন শিক্ষার্থী যদি সেই বিষয়ে ব্যাখ্যা, বর্ণনা, চিহ্নিতকরণ, বিশ্লেষণ এবং তার প্রয়োগ সম্পর্কে অবগত হয়, তখন তার জ্ঞান পরিপূর্ণ হয়। নচেৎ জ্ঞান জ্ঞানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এখানেই কারিকুলামের সার্থকতা। ফলকেন্দ্রিক কারিকুলামের আরেকটি বড় দিক দক্ষতা অর্জন।

মূলত চারটি দক্ষতা শিক্ষার্থীকে অর্জন করতে হয়। মৌলিক, সামাজিক, চিন্তাশীলতা ও ব্যক্তিগত দক্ষতা। মৌলিক দক্ষতার মধ্যে যোগাযোগ ও প্রায়োগিকতা অন্যতম। অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি এবং অর্জিত জ্ঞানের প্রয়োগের দক্ষতা অর্জন করতে হয়। পেশাগত জীবনে অন্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করতে হয়, যা তার পেশাগত জীবনের উৎকর্ষের জন্য প্রয়োজন। কোনো একটি বিষয় জানার পর সেই বিষয় সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করার দক্ষতা তাকে অর্জন করতে হয়। ব্যক্তিগত জীবনেও লেখাপড়ার ছাপ দৃশ্যমান হতে হয়। একজন শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব, মনোভাব, আবেগ, মানবিকতা ও অনুভূতির প্রকাশ তার পড়ালেখার মধ্য দিয়ে তৈরি হয়। কাজেই উপরোক্ত দক্ষতাগুলো অর্জন করতে পারলে তবেই তার লেখাপড়ার উদ্দেশ্য সফল হবে। মোটাদাগে পেশাগত জীবনে জ্ঞান প্রয়োগের দক্ষতা থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে কারিকুলাম অবদান রাখতে সক্ষম হয়।

আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন ফলকেন্দ্রিক কারিকুলামের ওপর জোর দিচ্ছে। কেননা শুধু কতগুলো বিষয় পড়ালেই লাভ হয় না, সেগুলো থেকে দক্ষতা অর্জন করে তার প্রয়োগের ওপরই নির্ভর করে তার আগামীর পথচলা। আমরা শুরু করেছি। এখন এর সঠিক বাস্তবায়নের ওপর দক্ষ জনশক্তি তৈরির বিষয়টি নির্ভর করছে।

লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ,

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

nahmed1973@gmail.com

শেয়ার করুন