গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার বিকাশ দরকার

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

রাজনীতি ও মিডিয়ায় হঠাৎই তৃণমূল বিএনপি বড় খবর হয়ে আবির্ভূত হলো। যদিও দলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠা থেকে যুক্ত থাকা বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। তিনি বিএনপি থেকে অনেকবারই বহিষ্কৃত হয়েছেন। শেষবার বহিষ্কৃত হওয়ার পর গঠন করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনুসরণ করে তৃণমূল কংগ্রেসের মতো তৃণমূল বিএনপি নামের একটি সংগঠন।

এ নিয়ে নানাজনের নানা কথা। সে কথায় তর্ক করে লাভ নেই। ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা তাঁর সংগঠনের আইনগত বিষয় নিয়ে আদালতে লড়াই করতে করতেই কয়েক বছর কেটে গেল। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে তিনি আদালতের রায় লাভ করেছিলেন, কিন্তু তখন তিনি ছিলেন মৃত্যুশয্যায়।

শুনে যেতে পেরেছিলেন কি না জানি না। এরপর তৃণমূল বিএনপির খবর খুব কমই গণমাধ্যমে এসেছে। যদিও তাঁর মেয়ে সংগঠনের হাল ধরেছেন বলে শোনা গেছে। তৃণমূল বিএনপি আবার রাজনৈতিক আলোচনায় আসবে সেটি অনেকেই ভাবতে পারেননি।

১৯ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমে তৃণমূল বিএনপির প্রথম সম্মেলন শেষে দলের চেয়ারপারসন পদে সাবেক কূটনীতিবিদ সমশের মবিন চৌধুরী বীরবিক্রম এবং মহাসচিব পদে তৈমুর আলম খন্দকারকে সর্বসম্মতভাবে নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হয়। উভয়েই একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষিত হয়নি। কবে কিভাবে হবে সেটি পরিষ্কার করা হয়নি। তৃণমূল বিএনপির খবরটি গণমাধ্যমে বিশেষভাবে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনায় আসার অন্যতম প্রধান কারণ হলো চেয়ারপারসন ও মহাসচিব পদে যাঁদের নির্বাচিত করা হয়েছে তাঁদের ব্যক্তিগত পরিচয়ের কারণে।

সন্দেহ নেই, সমশের মবিন চৌধুরী বছর পাঁচেক আগেই বিএনপি ছেড়ে বিকল্পধারায় যোগদান করলেও কয়েক বছর ধরে তিনি অনেকটাই রাজনীতি থেকে সরে যাওয়ার মতো অবস্থানে ছিলেন। গণমাধ্যমে তিনি দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক নানা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মত দেওয়ার কারণে অনেকের কাছেই ছিলেন একজন অভিজ্ঞ ও দক্ষ আলোচক। তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও পররাষ্ট্রসচিব ও কূটনীতিবিদ। বিভিন্ন দেশ সম্পর্কে তাঁর জানা ও দেখার ব্যাপক অভিজ্ঞতা রয়েছে। বাংলাদেশে এই সময়ে যে কয়জন আন্তর্জাতিক কূটনীতি নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ দিতে পারেন তাঁদের মধ্যে তিনি অন্যতম শীর্ষ ব্যক্তিত্ব—এতে কোনো সন্দেহ নেই। সে কারণে সমশের মবিন চৌধুরীকে অনেকেই একজন সজ্জন একাডেমিক কূটনীতি বিশেষজ্ঞ হিসেবেই দেখে থাকেন। তিনি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সব সময়ই নিজের পরিচয় তুলে ধরতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি তাঁর একটি পা হারিয়েছেন। গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার বিকাশ দরকাররণাঙ্গনের এই লড়াকু সৈনিক রাজনীতিতে বিএনপির সঙ্গে যুক্ত থেকে যতটা না পরিচিত ছিলেন, তার চেয়ে বেশি ছিলেন বীরবিক্রম এবং সাবেক কূটনীতিবিদ হিসেবে। তাঁর এমন অনেক পরিচয়ই তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসনের দায়িত্ব নেওয়ার খবরে অনেকেই জানার আগ্রহ দেখিয়েছেন। তাঁর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি, যা তিনি অর্জন করেছেন, তা দিয়ে তৃণমূল বিএনপি কতটা লাভবান হবে বা উচ্চতায় উঠতে পারবে সেটি শুধু সংগঠনটির আদর্শ, কর্মকাণ্ড, এমনকি যুগের চাহিদা পূরণের তাগিদ অনুভব করে সংগঠনকে গড়ে তোলার দক্ষতার ওপরই নির্ভর করবে। তৈমুর আলম খন্দকার বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত নেতা। তার পরও তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিএনপির দিকেই তাকিয়ে ছিলেন ডাক পাওয়ার। সেই ডাক আসেনি বলেই তৃণমূলের ডাকে সাড়া দিয়েছেন। ব্যাপারটি যদি এমনই হয়ে থাকে, তাহলে তৃণমূল বিএনপির জন্য কতটা রাজনৈতিকভাবে বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করবে, সেটি রাজনৈতিকভাবে চিন্তার অনেক প্রশ্ন জন্ম দেবে। মূল বিএনপি তৃণমূল বিএনপির প্রথম সম্মেলন এবং নতুন আংশিক কমিটি ঘোষণায় নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। কেউ এটিকে খড়কুটো, কেউ বা সরকারের ইশারা অথবা বিএনপিতে জায়গা না পাওয়া ব্যক্তিদের নতুন ঠিকানা হিসেবে অভিহিত করার চেষ্টা করছেন। বোঝা গেছে বিএনপির নেতারা তৃণমূল বিএনপির নতুন নেতৃত্ব দেখে মুখে অবজ্ঞার কথা বললেও ভেতরে এক ধরনের শঙ্কা অনুভব করছেন। এর কারণ হচ্ছে বিএনপি দীর্ঘদিন থেকে নানা অভ্যন্তরীণ সংকটে রয়েছে। অনেকেই বিএনপিতে ত্যাগী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, কিন্তু তাঁদের মূল্যায়ন হয়নি, নিষ্ক্রিয় হয়ে রয়েছেন। সুতরাং তাঁরা যদি এখন তৃণমূল বিএনপির দিকে হাত বাড়ান এবং সেটি যদি গৃহীত হয়, তাহলে তৃণমূল বিএনপির বিস্তারের কিছুটা হলেও তো সম্ভাবনার সৃষ্টি হবে। সেই বিবেচনা থেকেও মূল বিএনপির নেতাদের ভয় কিছুটা হলেও রয়েছে। তা ছাড়া বিএনপি যেভাবে সরকার পতন আন্দোলনের গোঁ ধরে বসে আছে তাতে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়টি তাদের দলীয় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরই নির্ভর করছে। আন্দোলন যদি সফল না হয়, তাহলে নির্বাচনে অংশ নেওয়া ছাড়া জনগণের সমর্থন পাওয়া-না পাওয়ার উপায় কী? এ অবস্থায় বিএনপির পদবঞ্চিত কিংবা বিক্ষুব্ধ নেতাদের অনেকেই যদি তৃণমূল বিএনপির টিকিট নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন, তাহলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনকে ঠেকানোর মূল বিএনপির কৌশল ভেস্তে যেতে পারে। এসব কারণেও বিএনপির মধ্যে এক ধরনের দুশ্চিন্তা বাড়তে পারে। তবে নিকট-ভবিষ্যতে তৃণমূল বিএনপি কতটা শক্তি অর্জন করতে পারবে তার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করবে।

দেশের রাজনীতিতে অনেকেই রাজনীতির দোকান খুলে বসে আছেন। তাঁদের ক্রেতা-বিক্রেতার দরকার নেই। সাইনবোর্ডটাই কোনো কোনো জোটের কাছে বিক্রি করার জন্য যথেষ্ট মূল্যবান। সেই মূল্যের উপঢৌকন আর্থিকভাবে কতটা পান-না পান তার চেয়েও বড় প্রাপ্তি দোকান মালিক রাজনৈতিক নেতা হিসেবে পরিচিতি পান, নির্বাচনে টিকিটও আদায় করে নিতে পারেন, জোট বিজয়ী হলে ব্যবসাপাতিও ভালোই জমাতে পারেন। নির্বাচনের প্রাক্কালে এ ধরনের নাম ও নেতাসর্বস্ব দলের গুরুত্ব কোনো কোনো জোটের কাছে থাকে বলেই নির্বাচনের আগে এগুলোর প্রচার ও প্রসার ঘটেই চলছে। কিন্তু আখেরে রাজনীতির জন্য এগুলোর কোনো মূল্য নেই। আবার অনেক কিংস পার্টিও গঠিত হয়। কিন্তু রাজনীতিতে ওই সব কিংসের আয়ু খুব দীর্ঘ হয় না। প্রাচীন ও মধ্যযুগে ছোট ছোট জনপদের প্রধানকে রাজা, মহারাজা, অধিশ্বর, নৃপতি ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হতো। সেই যুগের জন্য এমনটি স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ওই সব রাজার মধ্যে খুব কমই ইতিহাসে স্থান করে নিতে পেরেছেন। বর্তমান যুগে কিংস পার্টির আবেদন রাজনৈতিক দোকানদারের পরিচয়ের বেশি খুব একটা মূল্য যেমন থাকে না, কল্যাণও বয়ে আনে না। যদিও তেমন কল্যাণকামী কিংস পার্টি বাংলাদেশে ১/১১ সরকার গঠনের পর একাধিক হয়েছিল। অনেকেই দোকান বন্ধ করে উঠে গেছেন; একজনই শুধু আছেন, কিন্তু রাজনীতির জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনতে পেরেছেন কি না তা তিনি নিজেও হয়তো বলতে পারবেন না। এ রকম বহু রাজা ও প্রজাপার্টি রয়েছে, থাকবে। উদ্দেশ্য রাজার খেদমত করা কিংবা প্রজা হয়ে সেবা করা। এর জন্য তাঁরা জোট বাঁধেন, হাঁকডাক ছাড়েন। কিন্তু রাজনীতিতে তাঁদের প্রয়োজনীয়তা কী?

তৃণমূল সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে যদি চলতে চায়, তাহলে সমশের মবিন চৌধুরীকে স্বাধীনভাবে রাজনীতি ও দল বিনির্মাণের সুযোগ দিয়ে দেখতে পারে। আমাদের দেশে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলেই তাঁর মতো রাজনৈতিক, দেশীয় ও বৈশ্বিক জ্ঞানের অধিকারী নেতার উপস্থিতি খুব একটা দেখি না। কিন্তু দেশটাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ভিশনারি-মিশনারি রাজনৈতিক নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই। বঙ্গবন্ধু এক ঝাঁক যোগ্য রাজনৈতিক সহকর্মী নিয়ে দেশটাকে স্বাধীন করতে পেরেছিলেন। সেই নেতাদের হত্যা না করা হলে বাংলাদেশ ও এর রাজনীতি স্বাভাবিক গতিতে পরিচালিত হওয়ার মাধ্যমে অন্য উচ্চতায় ওঠার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। সামরিক শাসক আর সুবিধাবাদী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি অতি ডান, অতি বাম ও পরিত্যাজ্য রাজনীতিবিদ দিয়ে দেশটাকে দুই দশক পিছিয়ে দিয়েছে। শেখ হাসিনা দিনবদলের সনদ রূপকল্প প্রদান করে বাংলাদেশকে গত দেড় দশকে অর্থনৈতিকভাবে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছেন।

দেশে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রতিদ্বন্দ্বী দলের অনুপস্থিতির কারণে রাজনীতি, গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা-সংস্কৃতি আশানুরূপ বিকশিত হতে পারেনি। সে কারণেই দেশে যখন উচ্চারিত হয় ‘আমাদের সরকার ও বিরোধী পক্ষে যে দলই থাকুক, উভয়ই যেন হয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের।’ সে ক্ষেত্রে বিরাট অনুপস্থিতি ১৯৭৫ সালের পর থেকেই চলে এসেছে। এই অনুপস্থিতি বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্র বিকাশের ক্ষেত্রে বড় ধরনের শূন্যতা তৈরি করেছে। সমশের মবিন চৌধুরী বীরবিক্রম মুক্তিযোদ্ধাই শুধু নন, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকেই ধারণ করেন বলেই তাঁর কথা এত দিন শোনা গেছে। এখন তাঁর সম্মুখে চ্যালেঞ্জ নেওয়ার বিরাট সুযোগ এসেছে অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের ধারায় একটি রাজনৈতিক দলকে তৃণমূল থেকে গড়ে তোলার। সে ক্ষেত্রে তাঁর মূল দলের ভাবাদর্শে আটকে থাকলে পরিণতি হবে অন্য রকম। দেশের রাজনীতির বাস্তবতা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি অনুগত একটি মধ্যপন্থার উদারবাদী অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল গঠনের। তেমন দৃঢ় লক্ষ্য থাকলে তৃণমূল বিএনপিকে গঠনতন্ত্র, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড, নেতাকর্মীদের মনোজগৎ ইত্যাদি পরিবর্তনের মাধ্যমেই শুধু গড়ে তুলতে হবে। সে জন্য তৃণমূল বিএনপিকে গতানুগতিক রাজনৈতিক দলের দোকানে পরিণত করা নয়, বরং রাজনীতির পাঠশালায় পরিণত করা জরুরি হবে।

লেখক : ইউজিসি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফেলো ও সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন