পারমাণবিক জ্বালানি অর্জনের তাৎপর্য

অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম

স্বপ্নের রূপপুর বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রথম চুল্লিটির জন্য পারমাণবিক জ্বালানি ইতিমধ্যে দেশে আসতে শুরু করেছে। নির্মাণাধীন ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি চুল্লি চালু হলে ৬০ বছরব্যাপী নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে। প্রথম চুল্লিটির জন্য ইউরেনিয়াম-২৩৫-এর ৩-৫ শতাংশ সমৃদ্ধকরণসহ প্রায় ৭৫ টন ইউরেনিয়াম ডাই-অক্সাইড (UO2) জ্বালানির দরকার হবে। পারমাণবকি জ্বালানি রডে মূলত ইউরেনিয়াম-২৩৫ জ্বালানি হিসেবে কাজ করে, আর বাকি মৌলগুলো রড তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সিলিন্ডার আকৃতির ১.৫ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য ও ১ সেন্টিমিটার ব্যাসের তিন শতাধিক পেলেট দিয়ে ৩.৫-৪ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট একটি রড তৈরি করা হয়। বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম-২৩৫ ধাতু দিয়ে জ্বালানির রড তৈরি করা হয় না। অনেকগুলো জ্বালানি রড দিয়ে একটি বান্ডেল তৈরি করা হয়, যাতে পরিবহনে, চুল্লিতে স্থাপন করতে ও তুলতে সুবিধা হয়। এগুলোকে বলা হয় জ্বালানি বান্ডেল (ফুয়েল অ্যাসেম্বলি)। প্রতি ১৮ মাস অন্তর জ্বালানির চাহিদা হবে এক-তৃতীয়াংশ, অর্থাত্ ২৫ টন পরিমাণ ইউরেনিয়াম ডাই-অক্সাইডের রড চুল্লিতে স্থাপন করতে হবে এবং সেই পরিমাণ ব্যয়িত জ্বালানির রড চুল্লি থেকে তুলতে হবে। এই পরিমাণ জ্বালানি দিয়ে জাতীয় সঞ্চালন লাইনে যুক্ত হবে প্রকৃত ১ হাজার ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্। ৬০ বছর ধরে ১৮ মাস পর পর মাত্র দুই মাসের মতো বন্ধ রাখা ছাড়া (নতুন জ্বালানি ভরা, ব্যয়িত জ্বালানি তোলা এবং অন্যান্য রক্ষণাবেক্ষণ কাজ) বাকি সময়টুকু নিরবচ্ছিন্নভাবে ২৪/৭ সময়কাল ধরে চুল্লি চলতে থাকবে।

এই পরিমাণ বিদ্যুত্ কয়লা কিংবা তেল দিয়ে উত্পাদন করতে প্রতি ১৮ মাস পর পর জ্বালানি লাগবে প্রায় ১ কোটি মেট্রিক টন কয়লা, ১৯ কোটি গ্যালন তেল। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী এই পরিমাণ কয়লা ও তেল কিনতে লাগবে যথাক্রমে ৭ হাজার ৩০০ ও ৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। আর ২৫ মেট্রিক টন ইউরেনিয়াম জ্বালানি কিনতে লাগবে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। কয়লা ও তেলভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্রের আয়ুষ্কাল ২০-২৫ বছর এবং কার্বন নির্গমনের বিষয়টি তো হিসাবের মধ্যেই ধরা হয় নাই। এ জন্যই বলা হয়, পারমাণবিক শক্তি থেকে বিদ্যুত্ উত্পাদন হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব। পারমাণবিক জ্বালানি প্রথম বারের মতো বিমানযোগে দেশে এলো। এগুলো বিদ্যুেকন্দ্রে পৌঁছেছে সড়কপথে। টেকসই পরিবহনের কথা চিন্তা করলে আগামী দিনে পারমাণবিক জ্বালানি নৌপথে আসবে বলে আমার ধারণা।

universel cardiac hospital

অনেকেরই জানার আগ্রহ থাকতে পারে, পারমাণবিক জ্বালানি আসার পরই বুঝি দ্রুতই পারমাণবিক বিদ্যুত্ পাওয়া যাবে। যেমনটি হয়ে থাকে গ্যাস, কয়লা কিংবা তেলভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্রে। এ ক্ষেত্রে অনেকটা ভিন্নতা রয়েছে। হুট করেই জ্বালানির রড বান্ডেল চুল্লিতে স্থাপন কিংবা হুট করেই ব্যয়িত জ্বালানির রড বান্ডেল তুলে বিদ্যুত্ কেন্দ্র চালনা কিংবা বন্ধ করা যায় না। এটি চালু কিংবা বন্ধ করতে হয় অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত ও পরিকল্পিতভাবে। মানতে হয় আন্তর্জাতিক ও জাতীয় নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের বেঁধে দেওয়া নিরাপত্তার কঠোর বিধিনিষেধ। সব নিরাপত্তার বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনেই কেবল চালু কিংবা বন্ধ করতে হয়। চুল্লি চালকদের নিয়ে হয় দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ, অর্জন করতে হয় বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতা।

বাংলাদেশ এখন বাণিজ্যিক চুল্লি থেকে বিদ্যুত্ উত্পাদন করার জন্য পারমাণবিক জ্বালানির মালিক হলো। তার আগে ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাভারে অবস্থিত গবেষণা চুল্লি চালু করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে উচ্চতর সমৃদ্ধকরণ ইউরেনিয়াম (১৯.৭ শতাংশ, ট-২৩৫) জ্বালানি এনেছিল। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পারমাণবিক জ্বালানি বুঝে নেওয়ার ক্ষেত্রে পরীক্ষা করে দেখতে হবে চুল্লির কারিগরি নকশানুযায়ী জ্বালানি রডের দৈর্ঘ্য, ব্যাস ও অন্য কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি রয়েছে কি না। সবকিছু ঠিক থাকলে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ সরবরাহকৃত সব জ্বালানি রডের সঠিক সংখ্যা যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করে নির্ভুলভাবে বুঝে নিতে হবে এবং লিপিবদ্ধ রাখতে হবে। পারমাণবিক শক্তি নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে পারমাণবিক জ্বালানির হিসাব বুঝিয়ে দিতে হবে। পারমাণবিক শক্তি নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ জ্বালানি রডের সঠিক সংখ্যা আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থাকে (আইএইএ) লিখিতভাবে অবহিত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আইএইএ এই হিসাব সঠিক কি না, তা কাগজে-কলমে এবং সরেজমিনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবে। এক্ষেত্রে এক চুল পরিমাণ ব্যত্যয়ও গ্রহণযোগ্য হবে না। এটিই হচ্ছে একটি দেশের পারমাণবিক শক্তি শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের মূল ভিত্তি।

এখন সরবরাহকৃত ইউরেনিয়াম জ্বালানি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে এবং নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের নির্দেশিকা অনুযায়ী সঠিকভাবে জ্বালানি সংরক্ষণাগারে সংরক্ষণ করতে হবে। তারপর চুল্লিতে কখন এবং কীভাবে স্থাপন করবে তা পরিকল্পনা ও জ্বালানি ব্যবস্থাপনার গাইডলাইন অনুযায়ী হবে। এর জন্য তৈরি করতে হয় প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জ্বালানি ব্যবস্থাপনা দল, যাতে যে কোনো ধাপে কোনো প্রকার দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা না থাকে।

ইউরেনিয়াম জ্বালানি চুল্লিতে ঢোকানোর পর বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয় এবং প্রতিটি ধাপে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়। সবকিছু ঠিক থাকলে চুল্লি পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমে অল্প ক্ষমতায় চালানো হয়। পরে ধাপে ধাপে রয়েসয়ে প্রায় কয়েক মাসব্যাপী পরীক্ষামূলকভাবে বিভিন্ন ক্ষমতায় চালনার পর পূর্ণ ক্ষমতায় চুল্লি চালনা করার অনুমতি পায়। তখনকার সময়টাকে বলা হয় পূর্ণ ক্ষমতায় চুল্লি চালনা। যেটি আমরা সবাই চাই।

সবকিছু ঠিক থাকলে শিগিগরই বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি থেকে বিদ্যুত্ উত্পাদনকারী ৩৩তম দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করবে। তার জন্য মোকাবিলা করতে হবে আরো অনেক চ্যালেঞ্জ। প্রস্তুত করতে হবে সঞ্চালন লাইন, প্রশিক্ষিত জনবল, নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার রেগুলেশন ও গাইডলাইন, সরবরাহকারীর কাছ থেকে কারিগরি মানসম্পন্ন পারমাণবিক জ্বালানি সঠিকভাবে বুঝে নেওয়া, সঠিক হিসাব, সংরক্ষণ রাখার ব্যবস্থাদি, নিরাপত্তা প্রদান, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়ে মোকাবিলা করার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাদি প্রস্তুতকরণ, মাধ্যমিক ও নিম্নস্তরের বর্জ্য ব্যবস্থাদির ভৌত অবকাঠামো, বিকিরণ পর্যবেক্ষণ ও জনসচেতনতার ব্যবস্থা। জনসাধারণ যাতে বুঝতে পারে বিদ্যুেকন্দ্র চালুর আগে ও পরে বিকিরণের মাত্রা প্রায় কাছাকাছি আছে। এই নির্ভরযোগ্য, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব বিদ্যুতের সুফল আমরা জনগণই ভোগ করব। বাংলাদেশের এই মাইলফলক অর্জন করার জন্য সব অংশীজনকে অভিনন্দন।

লেখক : অধ্যাপক ও ফুলব্রাইট স্কলার, নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাবি এবং সাবেক ভিজিটিং অধ্যাপক, নিউক্লিয়ার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, এমআইটি, যুক্তরাষ্ট্র

শেয়ার করুন