চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সংকোচনমুখী নীতির বিকল্প নেই

ড. আতিউর রহমান

ড. আতিউর রহমান
ড. আতিউর রহমান। ফাইল ছবি

কদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের আমন্ত্রণে এক নীতি পর্যালোচনায় যোগ দিয়েছিলাম। সাবেক সিনিয়র অর্থসচিব ড. মোহাম্মদ তারেকও এই আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন। বিদ্যমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জসমূহ এবং সেসব থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতবিনিময়ের অংশ হিসেবেই এই আলোচনা আয়োজিত হয়েছিল। বরেণ্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই কার্যক্রমে পিআরআইয়ের অর্থনীতিবিদ ড. সাদিক আহমেদ ও ড. আহসান মনসুরও অংশগ্রহণ করেছেন এর আগে।

এরপর আলোচনায় অংশ নিয়েছি আমরা দুজন। এই ধারাবাহিক আলোচনায় সিপিডি ও সানেমের অর্থনীতিবিদরাও যোগ দেবেন। অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন ইআরএফের প্রতিনিধিদেরও এই আলাপে অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে।
আমরা যে আলাপে অংশ নিয়েছি তার শুরুতেই বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমান বিশ্ব অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ম্যাক্রো-অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরেন।

universel cardiac hospital

গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার মাঝেমধ্যেই সম্পূরক মতামত দেন। এ ছাড়া অর্থ বিভাগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দুই সচিবও এই আলাপে অংশ নেন। ডেপুটি গভর্নররাও ছিলেন। শুরুতেই ড. তারেক ও আমি মুদ্রা ও রাজস্বনীতি আরো সংকোচন করার লক্ষ্যে ‘অ্যাগ্রেসিভ’ নীতিকৌশলের আহ্বান জানাই।

মূল্যস্ফীতি বাগে আনার স্বার্থেই বাজেট ঘাটতি আরো কমিয়ে আনা (সম্ভব হলে ৩ শতাংশের কাছাকাছি নিয়ে আসা) এবং বাজার থেকে অর্থ সরবরাহ কমিয়ে চাহিদা নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতি সুদ বাড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছি আমরা। আশার কথা যে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারকরা আমাদের এই পরামর্শ স্বচ্ছন্দেই গ্রহণ করেছেন। আরো ভালো কথা যে এই আলোচনা শেষ করে বাড়ি ফেরার আগেই রেপো ও রিভার্স রেপো রেট ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়। সরকারি খরচ কমানোর প্রয়োজনও যে সরকার গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছে সে আভাসও সভায় পেলাম। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক হারের যে ব্যাপক তারতম্য দেখা দিয়েছে তা কমিয়ে আনার প্রশ্নে আমরা সুনির্দিষ্ট ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংক হয়তো স্বীয় অভিজ্ঞতার আলোকেই বুঝতে পারছে যে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার জেরে হুন্ডির চাহিদা বেড়ে গেছে। শিগগিরই এই পরিস্থিতির বদল হবে বলে মনে হয় না।

এমনই এক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় আমরা আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার বিষয়ে আলাপ করছি। এই মুহূর্তে আমরা প্রবৃদ্ধির আলাপ খুব গুরুত্ব সহকারে করছি না। নিশ্চয়ই পরবর্তী সময়ে সার্বিক পরিস্থিতির আরো উন্নতি হলে প্রবৃদ্ধির চাকাকে কিভাবে গতিশীল করা যায় তা নিয়ে আলোচনার সুযোগ রয়েছে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি ডলার-টাকা বিনিময় হারের অস্থিতিশীলতা এবং দ্রুত কমতে থাকা রিজার্ভ নিয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে। তবে এ বিষয়টি নিয়ে যেভাবে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে, তা সত্যি দুঃখজনক। এর চেয়ে অনেক কম পরিমাণের রিজার্ভ নিয়েও বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে চলেছে জোর কদমে। তবু এই দুশ্চিন্তাকে উড়িয়ে দেওয়াও ঠিক হবে না। দিনশেষে সাবধানের মার নেই। তাহলে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী?

টাকা ছাপিয়ে সরকারের বাজেট ঘাটতি মেটানোর নীতি থেকে সরে আসতেই হবে। এ জন্য অদরকারি বা তুলনামূলক কম অগ্রাধিকারের প্রকল্পগুলোতে অর্থায়ন বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া বৃহদাকার প্রকল্প যেগুলো সদ্য শুরু হচ্ছে, সেগুলোতে অর্থায়নও অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ রাখা চাই। আশার কথা এই যে সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকেও এমন বার্তাই পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এর মধ্যে সরকারি বন্ড ডেভেলমেন্ট (কেনার কর্মসূচি) থেকে সরে এসেছে। তাই ট্রেজারি বন্ডের দাম এখন বাড়ছে। এর সঙ্গে যোগ আছে সুদের হারের। সুদ না বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো বেশ মুশকিল।

অন্যদিকে সরকারি ব্যয় কাটছাঁটের সময় বিশেষ নজর দিতে হবে ভর্তুকি বাবদ ব্যয়ের দিকে। বিশেষ করে জ্বালানি ব্যয়ের ভর্তুকিতে যে ব্যয় হয়ে থাকে সেটির যৌক্তিকীকরণ এখন সময়ের দাবি। জ্বালানি বাবদ নিত্যদিনের ব্যয় এতে বাড়বে এবং জনগণের ওপর এর চাপ অবধারিতভাবেই পড়বে। এই মুহূর্তে জ্বালানি দামের স্বয়ংক্রিয় সমন্বয়ের উদ্যোগটি না নেওয়াই ভালো হবে। আরো আগে করলে ভোক্তারা সুবিধা পেত। এখন করলে লিটারপ্রতি ১০ টাকা দাম বেড়ে যাবে। তাই আগামী মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করাই শ্রেয় হবে।

বাজারে টাকার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে স্বভাবতই ঋণের সরবরাহ কমিয়ে আনার পরামর্শ আমরা দিয়েছি। অন্তত স্বল্প মেয়াদের জন্য হলেও আমাদের সংরক্ষণবাদী ঋণনীতি নিয়ে এগোতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে এ পথে কিছুটা এগিয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে মানি ট্রান্সমিশন চ্যানেলকে আরো সক্রিয় করার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে বিলাসদ্রব্য কিংবা তুলনামূলক কম দরকারি পণ্য আমদানির জন্য ঋণ সরবরাহের লাগাম শক্ত হাতে টেনে ধরতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক লেন্ডিং রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়েছে। স্মার্ট রেট বাড়ছে। আরো বাড়ানোর পরিবেশ তৈরি করতে হবে। অন্যদিকে বেশ কিছু আমদানি পণ্যের প্রবাহ কমানোর ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।

ঋণের সরবরাহ কমিয়ে আনার সময় অবশ্যই রিয়াল সেক্টর বা প্রকৃত অর্থনীতি বিশেষ করে কৃষির দিকে যত্নশীল থাকতে হবে। অনুৎপাদনশীল খাতে আপাতত ঋণ সরবরাহ বন্ধ করতে গিয়ে কোনো অবস্থায়ই যেন উৎপাদনশীল এ খাতে ঋণের প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সম্প্রতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে তাদের লক্ষ্যমাত্রার ৫০ শতাংশ নিজস্ব শাখাগুলোর মাধ্যমে বিতরণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে (বাকিটুকু হবে এমএফআইয়ের মাধ্যমে)। এটা করা গেলে মন্দ নয়, তবে খেয়াল রাখতে হবে এতে কৃষি অর্থায়ন বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি যেন তৈরি না হয়। কেননা অনেক বাণিজ্যিক ব্যাংকের পক্ষেই এমন পরিমাণের কৃষিঋণ নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে দেওয়া সম্ভব হবে না। বরং এমএফআইয়ের সঙ্গে পার্টনারশিপের ভিত্তিতে দেওয়ার সুযোগ থাকলেই কেবল তারা লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে। সুদের হারের চেয়ে কৃষিঋণের প্রাপ্তির বিষয়টি এখানে মুখ্য বিবেচনায় থাকা চাই।

বিদ্যমান বাস্তবতার নিরিখে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন করতে হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরে প্রায় ২৬ শতাংশ অবনমন ঘটানো হয়েছে টাকার। তবে এখনো অফিশিয়াল বিনিময় হারের সঙ্গে খোলাবাজারের বিনিময় হারের ব্যাপক পার্থক্য রয়ে গেছে। এতে বোঝা যাচ্ছে যে ডলারের বিপরীতে টাকার মানকে এখনো পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করা যায়নি। অর্থাৎ আরো অবমূল্যায়নের প্রয়োজন রয়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের এই ধারা যে সময়টায় অব্যাহত থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে, সে সময়ে অন্য দেশের সঙ্গে ‘কারেন্সি সোয়াপ’ বিশেষ সহায়ক হতে পারে। ভারতীয় রুপিতে বাণিজ্যের সুযোগ বেড়েছে। কিন্তু ওই দেশে আমাদের রপ্তানির পরিমাণ কম। তাই আরবিআইয়ের সঙ্গে আমরা স্বল্পকালীন দু-তিন বিলিয়নের সমপরিমাণ রুপির সোয়াপ করতে পারি। এই অর্থ দিয়ে ভারত থেকে আমদানি পণ্যের দাম মেটাতে পারি। ফলে ডলার রিজার্ভের ওপর চাপ কমবে। উদাহরণ হিসেবে এ বিষয়টি তুলে ধরলাম। এমন সৃজনশীল আরো অনেক উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ নিশ্চয় রয়েছে।

ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন চললে তাতে ব্যবসায়ীরা বিশেষ করে ছোট আমদানিকারকরা চাপে পড়বেন। এ ক্ষেত্রে মুদ্রানীতিতে তাদের জন্য বিশেষ কোনো আমদানি অর্থায়ন ব্যবস্থা করা যায় কি না তা ভেবে দেখা যায়। এ ছাড়া করনীতিতে কিছু ছাড় দিয়েও আমদানিকারকদের চাপ কিছুটা লাঘব করার কথা দ্রুতই ভাবা দরকার। তবে টাকার অবমূল্যায়নের ক্ষেত্রে বিশেষ নজর দিতে হবে উদ্যোক্তাদের ‘স্পেকুলেটিভ বিহেভিয়ার’ নিয়ন্ত্রণের দিকে। আমদানিকারকরাসহ অন্য অনেক অংশীজনই টাকার আরো অবমূল্যায়ন হবে—এমন ভাবনা থেকে বেশি বেশি ডলার হাতে রাখতে চাইবেন। এমনটি ঘটলে টাকার অবমূল্যায়ন করার পরও যথাযথ সুফল না-ও পাওয়া যেতে পারে। তাই রয়েসয়েই আমাদের এগোতে হবে। নিত্যপণ্য ও জ্বালানি আমদানির জন্য সতর্কতার সঙ্গে কিছু ডলার রিজার্ভ থেকে ছাড়তে হতে পারে। জনজীবনে স্থিতিশীলতার স্বার্থে এই ঝুঁকি হয়তো নিতেই হবে।

প্রবাস আয়ের প্রবাহই বাংলাদেশের জন্য বড় ভরসার জায়গা। অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে তথা হুন্ডির মাধ্যমে যাঁরা টাকা পাঠাচ্ছেন তাঁরা কেন আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে পাঠাচ্ছেন না তা আরো গভীরভাবে ভেবে দেখা খুবই জরুরি। ই-ওয়ালেট কিংবা এমএফএসের মাধ্যমে প্রবাস আয় দেশে পাঠানো সহজতর করতে হবে। কোনো অবস্থায়ই যাঁরা এসব চ্যানেল ব্যবহার করছেন তাঁরা যেন বিড়ম্বনার শিকার না হন তা নিশ্চিত করতে হবে। ধারণা করা যায়, অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে যাঁরা টাকা পাঠাচ্ছেন তাঁদের বড় অংশই অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে পাঠানোর ক্ষতি কিংবা আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে পাঠানোর সুবিধাগুলো সম্পর্কে সচেতন নন। ফলে তাঁদের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করে বিব্রত না করে তাঁদের ফিন্যানশিয়াল লিটারেসি কী করে বাড়ানো যায় সেদিকেই নীতি-মনোযোগ দিতে হবে।

ওয়েজ আর্নার্স কার্ডের সঙ্গে ন্যাশনাল আইডি কার্ডকে লিংক করে কিছু সুবিধা, যেমন—সন্তানদের পড়ালেখা, চিকিৎসাসেবা, বিমানবন্দরের লাউঞ্জ ব্যবহারের সুবিধা ইত্যাদি প্রবাসীদের জন্য নিশ্চিত করার কথা কি ভাবা যায়? এ ছাড়া মনে রাখতে হবে যে বর্তমানে আমাদের ওয়েজ আর্নার্স ডলার বন্ডের সুদহার সিকিউরড ওভারনাইট ফিন্যান্সিং রেট (এসওএফআর)-এর তুলনায় কম এবং দেশি মুদ্রার বন্ডের সুদহার বর্তমান মূল্যস্ফীতি ও বিনিময় হারের তুলনায় কম। তবে সম্প্রতি ডলার বন্ডের রিটার্ন ২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এটি নিয়ে আরো বেশি তথ্য অভিযানের প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নির্ধারিত স্মার্ট রেটের চেয়েও ৩ শতাংশ বেশি হারে সুদ দেওয়া যায় কি না তা ভেবে দেখা যায়।

প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনার কথা বা একেবারেই বিনা মূল্যে পাঠানোর সুযোগ তৈরির কথা ভেবে দেখা যায়। ব্যক্তি খাতের সব বাণিজ্যিক ব্যাংকও যেন প্রবাসীদের এমন সুবিধা দিতে পারে, তা নিশ্চিত করা দরকার। সব প্রতিষ্ঠানকে এই ফি বাবদ সরকার প্রণোদনা দিতে পারে। রিয়েল এস্টেট খাতে প্রবাসীদের বিনিয়োগকে উৎসাহিতও করা যেতে পারে। বিদেশি ব্যাংক থেকে স্বল্পকালীন যে আমদানি ঋণ নেওয়া হয় সেগুলা সময়মতো শোধ না করে কিছু ব্যাংক বড় অন্যায় করছে। বিদেশি অর্থায়নের এই সুযোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছে। এ বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরো গভীরভাবে ভাবতে হবে এবং কিছু একটা করতে হবে। বিদেশি ব্যাংকের প্রতিনিধিদের নিয়ে বসে তাদের সমস্যা সমাধানে ইতিবাচক বার্তা দিতে হবে। তবেই না তারা আরো বেশি করে বাংলাদেশকে আমদানি ঋণ সহায়তা দেবে।

খেলাপি ঋণ বেশ কয়েক বছর ধরেই আমাদের ব্যাংকিং খাতের বড় সমস্যা হিসেবে হাজির আছে। এই দুর্যোগের সময় হয়তো তা আমাদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোতে সুশাসন ও কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। বাসেল ০৩ নীতিমালা যেন প্রতিটি ব্যাংক মেনে চলে তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরো কঠোর হতে হবে। সর্বশেষ ফিন্যানশিয়াল স্ট্যাবিলিটি প্রতিবেদনে যে ৯টি ব্যাংক দুরবস্থায় রয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে, তাদের কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে সার্বক্ষণিক তদারকির বিকল্প নেই। তাদের বড় ঋণ দেওয়ার সুযোগ বন্ধ করতে হবে।

টেকনিক্যাল কিংবা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্সকেও গুরুত্ব দিতে হবে। খোলাবাজারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে ডলার বিক্রি কিংবা এলসি মনিটরিংসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেই দেখা যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক খাতের অংশীজনদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়াকেই প্রধান উপায় হিসেবে বিবেচনা করছে। আমার মতে, অংশীজনরা কোন বাস্তবতায় কমপ্লায়েন্ট না থেকে নিয়ম ভঙ্গ করছেন সেটি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে খুঁজে বের করা এবং সংলাপের ভিত্তিতেই তার সমাধানের পথনকশা দাঁড় করানোটিই সবচেয়ে কার্যকর।

সর্বোপরি নজর দিতে হবে কমিউনিকেশনের দিকেও। টাকার অবমূল্যায়ন কিংবা ঋণ সরবরাহ সংকুচিত করার মতো সিদ্ধান্তগুলো আমাদের নীতিনির্ধারকরা সুবিবেচনাবোধের জায়গা থেকেই নিয়ে থাকেন। কিন্তু এতে জনজীবনে যে সাময়িক হলেও দুর্ভোগ আসবে সেটিও তো সত্য। কিন্তু এই কঠোর ব্যবস্থাগুলো যে বাস্তবতার নিরিখে নিতেই হবে এবং এর ফলে দুর্ভোগগুলো সাময়িক আর দীর্ঘমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক সুরক্ষার জন্য যে এই পদক্ষেপগুলো জরুরি—এই বার্তাগুলো কি সব পর্যায়ের গ্রাহক তথা জনগণের কাছে পৌঁছাচ্ছে? তাই কোন পদক্ষেপগুলো কেন নেওয়া হচ্ছে এবং এর কী ফল হতে পারে তা জনগণের কাছে যথাযথভাবে কমিউনিকেট করার কাজটিও বাংলাদেশ ব্যাংককে করে যেতে হবে। কেননা আগাম নির্দেশনাও (ফরোয়ার্ড গাইডেন্স) কেন্দ্রীয় ব্যাংকিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ এক কৌশল বটে।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

শেয়ার করুন