করোনার পর যুদ্ধবিগ্রহ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সামগ্রিকভাবে বিশ্বের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে আরো অনগ্রসর করছে এবং তাদের জীবনযাত্রার মান পেছনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এদিকে একশ্রেণির মুনাফাখোর ও প্রবঞ্চক আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে পিছিয়ে পড়ার ফলে মানুষের মধ্যে বাড়ছে অসহিষ্ণুতা। ঘুণে ধরা সামগ্রিক বৈশ্বিক পটভূমিতে অনগ্রসরমানতা ও মানবীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় লক্ষ করা যাচ্ছে। যুদ্ধবিগ্রহের কারণে বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদেরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার প্রবৃদ্ধি ২০২৩ সালে ১.৯ শতাংশ হ্রাস পাবে, যা ২০২২ সালে ৬ শতাংশ হয়েছিল, যখন গালফ অঞ্চলের রাষ্ট্রসমূহ তেলের দাম বাড়ার ফলে লাভবান হয়েছিল।
আসলে যুদ্ধ নারী, শিশু ও পুরুষ সবার জীবনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে থাকে। এ কারণে কর্মবাজার সংকুচিত হয়, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়, দুর্নীতি ও কালোবাজারি বৃদ্ধি পায়, মানুষের জীবনধারণ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ে। উন্নয়নহীনতা ও বণ্টনব্যবস্থায় অসাম্য মানুষকে একেবারে অন্ধকারের গহ্বরে ঠেলে দেয়। নিহত-আহত সবাইকে একটি মানবসৃষ্টিজাত দুর্ভোগ পোহাতে হয়। কারোনাকালে যে দৈবদুর্বিপাকে অনেকে নিঃস্ব হয়েছিল, তাদের অবস্থা আরো খারাপের দিকে। এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। এ থেকে উত্তরণ পেতে হলে কেবল যুদ্ধ বন্ধ করলেই হবে না, বরং সঠিক মাত্রায় পুনর্বাসনের কাজ বৈশ্বিকভাবে করতে হবে।
মর্গান স্ট্যানসির গবেষণায় অর্থনীতিবিদেরা দেখিয়েছেন যে, বৈশ্বিক যুদ্ধবিগ্রহের কারণে ২০২৩ সালে বিশ্বের মোট দেশজ উত্পাদন হবে ২.৯ শতাংশ, যা ২০২২ সালে ছিল ৩.৪ শতাংশ। বৈশ্বিক যুদ্ধ ভেঙে দেয় ঘরবাড়ি, মানসিক ক্ষত সৃষ্টি করে পরিবারে, ধ্বংসের লীলাখেলায় সমৃদ্ধশীল মানুষও পথহারা-দিশেহারা হয়ে প্রান্তরে দাঁড়ায়। এমন মরণখেলার নেশায় যারা লিপ্ত হয়, সামগ্রিকভাবে তারা সামষ্টিক অর্থনীতিতে লাভবান হলেও ব্যাস্টিক পর্যায়ে কত মানুষ, সৈনিক, সেনাপতি ধ্বংসের তান্ডবে আর ঘরে ফিরতে পারে না, তার ইয়ত্তা নেই। অস্থিতিশীল পরিবেশে মানুষের মধ্যকার কদাকার চিহ্ন বেরিয়ে আসে। হাসপাতালে বোমা বর্ষণ করে ৫০০ নিরীহ মানুষকে মেরে আর যাই হোক, তাদের পরিবার-পরিজনকে উন্মত্ত পৈশাচিকতা ও নৃশংসতার মধ্যে ঠেলে দেওয়া যায়। অস্ত্র ব্যবসায়ীরা অবশ্য যুদ্ধের মাধ্যমে লাভবান হন। তবে নীরবে নিভৃতে কাঁদে মানবতা। যুদ্ধবাজরা পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে তাদের অর্থনীতির সামষ্টিক আর্থিক ক্ষমতাকে আরো সক্ষম করে তোলেন। বিশ্বের অতি প্রয়োজনীয় সম্পদের এক স্থান থেকে আরেক স্থানে পাঠানোর ক্ষেত্রে বাধাবিপত্তি বাড়তে থাকায় মূল্যস্ফীতির হার পৃথিবীতে উচ্চ পর্যায়ে চলে যায়। সরবরাহজনিত ব্যবস্থাপনা এ সময় ভেঙে পড়তে থাকে।
উল্লেখ্য, বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির হার ২০২২ সালে ৮.২৭ শতাংশ ছিল, অথচ ২০২১ সালে ছিল মাত্র ৩.৪৮ শতাংশ এবং ২০২০ সালে ছিল আরো কম, ১.৯৩ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি বৈশ্বিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। এমনকি কৃচ্ছ্রসাধনের উপায় একটি পর্যায়ে শেষ হয়ে যায়। এদিকে সাব সাহারার রাষ্ট্রসমূহে মূল্যস্ফীতির হার হচ্ছে ৯.৩৯ শতাংশ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে ৮.৮৩ শতায়ংশ, ইউরো এলাকায় ৮.৪০ শতাংশ, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে ৮.৩০ শতাংশ, উত্তর আমেরিকায় ৭.৪০ শতাংশ, দক্ষিণ এশিয়ায় ৭.২০ শতাংশ এবং পূর্ব এশিয়া ও প্যাসিফিকে ৫.৪১ শতাংশ (২০২২ সালে)। উচ্চ মূল্যস্ফীতিজনিত সমস্যার কারণে সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি হয়, আয়-বৈষম্য প্রকট হয়, মানুষের জীবনে দুঃখ দেখা দেয়। দারিদ্র্য, কর্মপ্রবাহ নষ্ট হয়। দারিদ্র্যের দুষ্টুচক্র প্রকটিত হয়। মানুষ স্বাভাবিক জীবন-পরিবেশে বসবাস করতে না পেরে খোলা হাওয়ায় অস্বাস্থ্য ও দুস্থ পরিবেশে বসবাস করে। মৃতদেহ সত্কারের পরিবেশ পর্যন্ত থাকে না। সামষ্টিক অর্থনীতিতে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিতে বড় ধাক্কা লাগে। যুদ্ধের কারণে দুঃখী মানুষেরা আরো দুঃখে পতিত হয়।
ইসরাইল ও প্যালেস্টাইনের মধ্যকার যুদ্ধের জন্য বৈশ্বিক ভূরাজনীতি ও আর্থসামাজিক পরিবেশে মানুষের স্বাভাবিক জীবনবোধ নষ্ট হচ্ছে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে। এ ধরনের ঘটনাপ্রবাহের কারণে আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে শেষ পর্যন্ত বৈশ্বিক মন্দাবস্থাকে আরো প্রকট করে তোলে। এ ধরনের কর্মকান্ডে বৈশ্বিক বিনিয়োগব্যবস্থায় ধাক্কা লেগে থাকে। এমনিতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে ও বাণিজ্যে গ্লোবাল মেল্টডাউন (Global Meltdown) চলছে বিশ্বব্যাপী। সুযোগ বুঝে যারা উত্পাদনকারী ও সরবরাহকারী, তারা সমগ্র বিশ্বে তাদের পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। নিত্য পর্যায়ের ব্যবহারযোগ্য পণ্য থেকে আরম্ভ করে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, এমনকি উড়োজাহাজে ভ্রমণের ক্ষেত্রেও উচ্চমূল্য কয়েক গুণ বেড়ে চলেছে। আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক পর্যায়ে দ্রব্যের দামের পদ্ধতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বরং ক্রেতাদের উদ্দেশে একচেটিয়ামূলক কারবারির মতো দ্রব্যের দাম হাঁকানো হচ্ছে। এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল বনাম প্যালেস্টাইন যুদ্ধের কারণে এই অঞ্চল থেকে যে বৈশ্বিকভাবে এক-তৃতীয়াংশ তেল উত্পাদিত হয়, তার বাজার ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। এতে বৈশ্বিক তেল সরবরাহজনিত সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে যারা আগে তেলের দাম দিয়েছে এবং বর্তমানে যে তেলের দাম পরিশোধযোগ্য, তার মধ্যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আন্তর্জাতিক রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যেতে পারে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে একের পর এক বৈশ্বিক শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহ জড়িয়ে পড়েছে। ষাটের দশকে দুটি রাষ্ট্র পরাশক্তি ছিল, আশির দশকে একটি রাষ্ট্র শক্তিশালী হয়ে ওঠে, কিন্তু এখন পাঁচটি রাষ্ট্র পরাশক্তির অধিকারী। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর এখন ইসরাইল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক আর্থিক বাজারে অস্থিরতা বাড়বে এবং আঞ্চলিক রাষ্ট্রসমূহ তাদের আধিপত্য ছোট রাষ্ট্রসমূহের ওপর বিস্তার করতে থাকবে। যদি ইরানও যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তবে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে তেলের দাম আরো বেড়ে যাবে এবং মূল্যস্ফীতির চাপ উন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত সব দেশে অনুভূত হবে। যদি যুদ্ধ দীর্ঘদিন চলে, তাহলে আন্তর্জাতিক মুদ্রানীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, ঋণ গ্রহণের খরচ আন্তর্জাতিকভাবে বেড়ে যাবে, বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের পুনঃঅর্থায়ন করার ক্ষমতা কমে যাবে। এমনকি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারে উচ্চমূল্যস্ফীতি থেকে হাইপার মূল্যস্ফীতি দেখা দেবে। আন্তর্জাতিকভাবে শ্রমবাজারে যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবে, তার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বিদেশি শ্রমিকেরা কর্মচ্যুত হয়ে দেশে ফেরত চলে আসবে। আবার বিভিন্ন রাষ্ট্রের রপ্তানির সক্ষমতা হ্রাস পাবে।
বিশ্বে এই মুহূর্তে সাধারণ মানুষ ইসরাইল ও প্যালেস্টাইনের যুদ্ধের বিপক্ষে হলেও মার্কিন যুুক্তরাষ্ট্র ও কতিপয় পশ্চিমা রাষ্ট্র ইসরাইলের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নিয়েছে, অন্যদিকে চীন ও রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এর ফলে নতুন করে ভূরাজনৈতিক ও আর্থ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি নতুন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যা বিশ্বকে একটি দ্বিধাবিভক্ত আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এই দু্ই যুদ্ধ আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। একশ্রেণির আন্তর্জাতিক রাজনীতিবিদ যুদ্ধকে পুঁজি করে কিংবা ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে নিজ দেশে নির্বাচনি বৈতরণি সহজে পার হতে চান। অথচ এরূপ পরিস্থিতি কখনো কাম্য হতে পারে না। আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানিদের চরম অত্যাচার ও ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছি এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হতে দেখেছি।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে বলেছেন, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং প্যালেস্টাইনের ওপর ইসরাইলিদের আঘাত বর্তমানে যা দেখছি, তা এখনই বন্ধ হওয়া উচিত। তিনি অস্ত্রের ঝনঝনানি এবং অস্ত্রবাজদের হাত থেকে নারী ও শিশুদের বাঁচানোর অনুরোধ জানিয়েছেন বিশ্বনেতাদের কাছে। আসুন, আমরা সবাই এক বাক্যে বলি, বৈশ্বিক শান্তির জন্য, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ‘যুদ্ধ বন্ধ চাই’। মোবাশ্বের আলী ‘বিশ্বসাহিত্যে’ বইয়ে লিও তলস্তয়ের ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ উপন্যাস সম্পর্কে বলেছেন, ‘যুদ্ধ মানেই বর্বরতা, ধ্বংসযজ্ঞ ও মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়া।’ পক্ষান্তরে, ‘শান্তি মানুষের মঙ্গল যাঞ্চনা করে, উন্নয়ন করে, সুন্দর সমাজব্যবস্থা ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করে থাকে।’ তাই বিশ্বঅর্থনীতিকে বাঁচাতে যুদ্ধ বন্ধের কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : সামষ্টিক ও আর্থিক অর্থনীতিবিদ ও আইটি বিশেষজ্ঞ। সাবেক ভিসি, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা