রাজনীতিতে অক্টোবর সিনড্রোম

আবদুল মান্নান

আবদুল মান্নান
আবদুল মান্নান। ফাইল ছবি

এই লেখাটি যখন পাঠকের হাতে পৌঁছাবে, তখন তুমুল আলোচিত ২৮ অক্টোবর তারিখটা শেষ হয়ে বিশ্ব ২৯ তারিখে প্রবেশ করবে। এই ২৮ তারিখ বিএনপিসহ তাদের জোটসঙ্গী প্যাডসর্বস্ব ৩০টির বেশি দলের দাবি অনুযায়ী শেখ হাসিনার সরকারের পতনযাত্রা শুরু হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। তেমনটি হওয়ার কোনো আশঙ্কা কখনো দেখা যায়নি। ২০০৮ সালে সাধারণ নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর থেকেই কী উপায়ে সরকারকে উৎখাত করা যায় সেই লক্ষ্যে বিএনপি শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে নানা কর্মসূচি বা আন্দোলন করে এসেছে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে যখনই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে, তখনই দেশের অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলো এক হয়ে তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে সেই সরকার উৎখাতের চেষ্টা করেছে। সেখানে বাম বা ডানপন্থী দল বলে কোনো বাছবিচার ছিল না। আজকের প্রজন্ম হয়তো জানে না পাকিস্তানের ২৩ বছর শাসনামলের পুরো সময়টায় এ দেশে বাম ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম নিষিদ্ধ ছিল। বঙ্গবন্ধু তাদের প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

universel cardiac hospital

মওলানা ভাসানীর মতো নেতা ন্যাপ গঠন করার পর তাঁর দলের দর্শন হিসেবে ‘সমাজতন্ত্রের’ আগে ‘ইসলামিক’ শব্দটি জুড়ে ‘ইসলামিক সমাজতন্ত্র’ নামের সমাজতন্ত্রের এক অদ্ভুত সংজ্ঞার জন্ম দিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে একটি পশ্চিমা শক্তি খুবই তৎপর ছিল। তাদের সঙ্গে এই বামপন্থীদের কেউ কেউ জড়িত ছিল। আর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর এ দেশে বেশ পাকাপোক্তভাবে ঘাঁটি গেড়েছিল পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই।

উদ্দেশ্য বাংলা নামের দেশটাকে অকার্যকর করা। তাদের সহায়তায় বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল জঙ্গিদের চারণভূমি। আর উত্তর-পূর্ব ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছে বেআইনি অস্ত্র চোরাচালানের নিরাপদ রুট। সেই আইএসআইয়ের সঙ্গে এখনো নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ রাখছে বর্তমান সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে যারা লিপ্ত, তাদের মুরব্বি দল বিএনপি। ২০১৭ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার লন্ডন সফরকালে সেখানে বসবাসরত তাঁর পলাতক সন্তান তারেক রহমানের সহায়তায় আইএসআইয়ের একাধিক শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক হওয়ার সংবাদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল।

এ কারণে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলাও হয়েছিল, যদিও বিএনপি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বর্তমানে এসবের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাত করার জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়েছে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’। এটি সম্পর্কে বিএনপি কখনো কোনো কথা বলেনি। এ কারনেই বর্তমানে িফলিস্তিনে ইসরায়েলের যে নৃশংসতা চলছে, সে সম্পর্কে বিএনপি বা তার মিত্রদের কোনো বক্তব্য নেই। এসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে বিদেশি একটি শক্তিশালী দেশ, যাদের অন্য দেশে সরকার পরিবর্তনের পারদর্শিতা প্রমাণিত।

২০০৮ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর থেকেই বিএনপি তার মিত্রদের নিয়ে দাবি করে আসছে নির্বাচন হতে হবে একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে, যদিও এর পক্ষে তারা কোেনা গ্রহণযোগ্য কারণ দেখাতে পারেনি। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব আন্দোলনরত দল একমত হয়েছিল পরবর্তী তিনটি সংসদ নির্বাচন এমন একটি সরকারের অধীনে হবে। তবে এর নাম তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল না। বলা হয়েছিল, এমন সরকারের প্রধান হবেন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন সুধীজন, হতে পারেন তিনি একজন বিচারপতি। ১৯৯১ সালে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে খালেদা জিয়া অনেকটা ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে গেলেন। মাগুরা আর ঢাকা-১০-এর দুটি উপনির্বাচনে তাঁর আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের নামে এমন তামাশা জাতিকে উপহার দিল যে তা সব মহলকে স্তম্ভিত করে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুর রউফ ভয়ে মাগুরা থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। তীব্র গণ-অান্দোলনের মুখে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির আরেক তামাশাপূর্ণ নির্বাচন করে বিএনপি সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করে এক মাসের মাথায় পদত্যাগ করে। পরের নির্বাচনে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেন। তিনি তাঁর মেয়াদ শেষ করে শান্তিপূর্ণভাকে বিচারপতি লতিফুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। পরের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট জয়ী হয়। আবার খালেদা জিয়া ক্ষমতার মোহের কাছে পরাজিত হয়ে যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকার সব ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে ফেলেন। আবার গণ-অান্দোলন আর তার প্রেক্ষাপটে অসাংবিধানিকভাবে ১/১১-এর সরকার।

২০০৫ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, যা সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী হিসেবে পরিচিত, তার বিরুদ্ধে আবদুল মান্নান খান নামক জনৈক ব্যক্তি উচ্চ আদালতে একটি রিট মামলা করেন। সেই মামলার শুনানি দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। সর্বোচ্চ আদালত ২০১৩ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীকে দেশের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে তা বাতিল করে দেন। রায়ে আরো বলা হয়, সাংবিধানিকভাবে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এক মিনিটের জন্যও রাষ্ট্রের শাসনভার কোনো অনির্বাচিত ব্যক্তির হাতে যাওয়া কাম্য নয়। রায়ে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার শুধুমাত্র জনগণের নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্যগণ দ্বারা গঠিত হইতে পারে।’ রায় স্পষ্ট। আদালত তাঁর দীর্ঘ বিশ্লেষণে এক জায়গায় মন্তব্য করে বলেন, সংসদ যদি চায়, তাহলে ‘দশম ও একাদেশ সর্বোচ্চ…দুইটি সাধারণ নির্বাচন জাতীয় সংসদের বিবেচনা অনুসারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে হইতে পারে।’ আদালত তাঁর মন্তব্যে আরো বলেন, এমন ব্যবস্থা যদি হয়, তাহলে অবসরপ্রাপ্ত কোনো প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের কোনো বিচারপতিকে রাখা যাবে না। বিএনপি যে সরকারের জন্য ২০০৯ সালের পর থেকে রাজপথ উত্তপ্ত করছে, ২০১৩-১৫ সালে সারা দেশে অগ্নিসন্ত্রাস সৃষ্টি করে যে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি করেছিল, তা কোন ভরসায় করেছিল বা করছে?

অক্টোবর মাসটি বিএনপির জন্য তেমন একটি গৌরবের মাস নয়। ১৯৭৭ সালের ২৬ অক্টোবর এই দলের প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের এক সমাবেশে বক্তব্য দিতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের হাতে চরমভাবে লািঞ্ছত হন। সেই প্রতিবাদ সমাবেশে যে শিক্ষক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তিনি বর্তমানে বিএনপির একজন শীর্ষ পর্যায়ের নেতা। এর আগে ২ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রথম সেনাশাসক জিয়াকে উৎখাত করার জন্য বিমানবাহিনীর সদস্যরা এক সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এই অপরাধে জিয়া বিনা বিচারে এক হাজারের বেশি বিমান ও সেনা সদস্যকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেন। নিহতদের লাশও তাঁদের স্বজনদের কাছে কখনো ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। এমন নিষ্ঠুর আচরণ ইতিহাসে খুব কম দেখা যায়।

খালেদা জিয়ার শাসনামলে ২০০১ সালে রচিত হয়েছিল ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। বিচারপতি লতিফুর রহমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১ অক্টোবর একটি অত্যন্ত বিতর্কিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এ দেশে। সেই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট বিজয় হয়েছিল। নির্বাচনের রেশ না কাটতেই দক্ষিণ বাংলায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর এক ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে এসেছিল। সে সময় ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, হত্যাএমন কোনো অপকর্ম নেই, যা বিএনপি-জামায়তের কর্মীরা করেননি। সেই সময় কয়েক হাজার মানুষ ভিটামাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে দেশত্যাগী হয়েছিল।

২০০৬ সাল। খালেদা জিয়া সরকারের মেয়াদ শেষ। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি শুরু করল নানা ধরনের ফন্দি-ফিকির। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে মনোনীত হলেন দলটির একান্ত আস্থাভাজন বিচারপতি আজিজ। তাঁর নেতৃত্বে প্রস্তুত করা হলো একটি ভোটার তালিকা, যার মধ্যে সোয়া কোটি ভুয়া ভোটার অন্তর্ভুক্ত করা হলো। নিজস্ব দলীয় মানুষকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার জন্য বৃদ্ধি করা হয়েছিল বিচারপতিদের বয়স। আওয়ামী লীগ ও তার সমমনা দলগুলো ঘোষণা দিল এই পরিস্থিতিতে তারা নির্বাচনে যাবে না। আওয়ামী লীগ বা তাদের মিত্ররা কখনো এই দাবি করার সুযোগ পেত না, যদি খালেদা জিয়া নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য নানা রকম জালিয়াতির আশ্রয় না নিতেন। খালেদা জিয়া ঘোষণা দিলেন, কোনো দল নির্বাচনে না এলে নির্বাচন বসে থাকবে না। দুই পক্ষই তাদের দাবিতে অনড়। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপি নয়া পল্টন দলীয় অফিসের সামনে, জামায়াত বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট আর আওয়ামী লীগ পুরানা পল্টনে সমাবেশ ডেকেছিল। পুরানা পল্টনে শ্রমিক লীগকে পুলিশ সমাবেশের অনুমতি না দেওয়ায় বাধ্য হয়ে আওয়ামী লীগ ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে তাদের সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সমাবেশের দিন খালেদা জিয়া সরকার তার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে নিজেদের সুরক্ষার জন্য ব্যবহার করে। একসময় অনেকটা জামায়াতের উসকানিতে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ সহিংস আকার ধারণ করে; যার ফলে অন্তত পাঁচজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়।

এই ২৮ অক্টোবরের পর ধরে নিতে হবে বিএনপি ও তার মিত্রদের শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করার পথ সংকুচিত হয়ে পড়বে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন একটি ছোট সরকার গঠিত হওয়ার কথা। তাদের দলের বাইরে অন্য দলের সংসদ সদস্যরাও সেই সরকারে থাকতে পারেন। এই সংসদে বিএনপির সাতজন সদস্য ছিলেন। সংসদ থেকে তাঁদের পদত্যাগ ছিল অত্যন্ত অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত। সংসদে থাকলে তাদের দু-একজন সদস্যও সরকারে থাকতে পারতেন। সেই সম্ভাবনা এখন তিরোহিত। এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি ও তার মিত্রদের একমাত্র বাস্তব বিকল্প হচ্ছে সংবিধানের আলোকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। তারা কী করবে, এটা তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। শুভ বুদ্ধির জয় হোক।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

শেয়ার করুন