১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ছিল ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে অর্থনীতির আকার বেড়ে হয়েছে ৪৬০ বিলিয়ন ডলার। বৈশ্বিক এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার বেড়েছে। তবে রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরুর পরপরই বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি চাপের মধ্যে পড়ে। কারণ, বাংলাদেশ প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জ্বালানি তেল (পরিশোধিত এবং অপরিশোধিত), গ্যাস ও কয়লা আমদানি করে থাকে। শুধু জ্বালানি তেল আমদানিতে ব্যয় হয় ৫-৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্ববাজারে এ তিনটি পণ্যের দাম বেড়ে গেলে এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের বাজারে। আমদানিকৃত পণ্যের দাম বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি স্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। রপ্তানিকারক দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে এবং সরবরাহ চ্যানেল বিঘ্নিত হলে আমদানিকারক দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। মূল্যস্ফীতির ফলে আয়বৈষম্য বাড়ে, ডলারের দাম বাড়ে, টাকার অবমূল্যয়ন হয়, ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। এক পর্যায়ে মূল্যস্ফীতির ফলে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়।
গত দেড় বছর ধরে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ওপর। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ, যা ১১ বছর সাত মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড করা হয় ৯ দশমিক ২ শতাংশ। সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে হলে মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট গভীর হওয়ার পেছনে মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচক দায়ী। উল্লেখ্য, অর্থনৈতিক সংকট সমাধান করার জন্য যে নীতিগুলো গ্রহণ করা হয়েছে, তা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। অনেক সময় বৈশ্বিক কারণে নীতিগুলো অকার্যকর হয়ে যায়। অতি সম্প্রতি যুদ্ধ শুরু হয়েছে ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েলের মধ্যে। এ সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়ে যাবে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। সংঘাত শুরুর পরপরই তেলের দাম ৭ শতাংশ বেড়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্য সংকটের প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে। অর্থনৈতিক সংকট গভীর হওয়ার পেছনে আরো দায়ী রয়েছে দুর্বল মুদ্রানীতি এবং রাজস্বনীতি। বিশ্বব্যাংক বলেছে যে, দুর্বল মুদ্রানীতি, জ্বালানির উচ্চ মূল্য, টাকার অবমূল্যয়ন, পণ্যের সরবরাহ সংকট এবং আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। এছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চার ধরনের সংকট রয়েছে : (১) উচ্চ মূল্যস্ফীতি (২) ব্যবসায়-বাণিজ্যে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির চাপ (৩) আর্থিক খাতের ঝুঁকি (৪) আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে অস্থিরতা।
মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি বর্তমানে অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের ক্ষয়রোধ করা। আমদানিনির্ভর অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ক্ষয় হতে থাকলে এর চেয়ে সংকটাপন্ন পরিস্থিতি আর হতে পারে না। এ পরিস্থিতি রাতারাতি সামাল দেওয়া সহজ কাজ নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড করা হয়েছিল ৪৮ দশমিক ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ বছরের অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ২৬ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, রিজার্ভ দাঁড়ায় ২১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। আর নিট রিজার্ভ হয় ১৭ বিলিয়ন ডলারের নিচে। অর্থাত্ তিন মাসের আমদানি দায় মেটানোর জন্য রিজার্ভ রয়েছে, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। রিজার্ভ বাড়ানোর পথগুলো দিনে দিনে সংকীর্ণ হয়ে আসছে। রিজার্ভ বাড়ানোর পথগুলো হলো—প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয়, বিদেশি ঋণ, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ। দুঃখজনক হলো এর কোনোটি ভালো অবস্থানে নেই।
এক সংবাদপত্রের প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স কমেছে ১৩ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ২৯ শতাংশ, বিদেশি ঋণ ছাড় কমেছে ১১ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বর মাসে রপ্তানি কমেছে ৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা। পক্ষান্তরে, রিজার্ভ থেকে বিদেশি ঋণের আসল এবং সুদ বাবদ ব্যয় ইদানীং বেড়ে গেছে। এ অর্থবছরের শুরুতে মূল বিদেশি ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ২৯ শতাংশ এবং সুদ বাবদ পরিশোধ বেড়েছে ৫৮ শতাংশ। বলা প্রয়োজন যে, বর্তমানে বিদেশি ঋণের সুদহার বেড়েছে ৯ শতাংশ, যা দুই বছর আগে ছিল মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ। সুদহার বেড়ে যাওয়ার কারণও রয়েছে। অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক রেটিং এজেন্সি মুডিস এবং ফিচ বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং কমিয়েছে। এ অবস্থায় বিশেষ ঋণে দ্বিগুণের বেশি হলে বিশ্বব্যাংক ৫ শতাংশ হারে সুদ চায়। কোনো দেশের ক্রেডিট রেটিং কম হলে ঋণদাতা সংস্থাগুলো বেশি সুদ হার আরোপ করে থাকে। এ পরিস্থিতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কীভাবে বাড়বে? আমদানি নিয়ন্ত্রণ করেও রিজার্ভের সংকট কাটানো সম্ভব হয়নি। রিজার্ভের এ পরিস্থিতি থেকে উত্তোলন হতে না পারলে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি দেখা দেবে বাংলাদেশে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তানুযায়ী, এ বছরের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে রিজার্ভ ২৬ বিলিয়ন ডলারে নিতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কি এটা সম্ভব?
দুঃখজনক হলো, ডলারের দাম এখনো বাজারভিত্তিক করা হয়নি। কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম বেশি দেওয়ার কারণে বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে। ডলারের দাম বেঁধে দেওয়ার কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স কাঙ্ক্ষিত হারে আসছে না। সম্প্রতি প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স রেকর্ড করা হয়েছে, যা ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। ডলারের দাম বাজারভিত্তিক না হলে কখনো বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়বে না। গত তিন বছরে বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে শ্রমিকের অভিবাসন হয়েছে চার গুণের কাছাকাছি। সৌদিআরব থেকে রেমিট্যান্স কমেছে ১৭ শতাংশের বেশি। অন্যদিকে খেলাপি ঋণ এখন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বহুল আলোচিত। খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমাতে না পারলে ব্যাংকগুলো মুনাফা হারাবে এবং তারল্য সংকটে পড়বে। ব্যাংকের কাছে পর্যাপ্ত তারল্য না থাকলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে যাবে। এর ফলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বর্তমানে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ২২ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন (৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ) । আইএমএফ তিন থেকে চার বছর আগে বলেছিল যে, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ জিডিপির ২৪ থেকে ২৫ শতাংশ (প্রায় ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকা)। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, এ বছরের জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণ রেকর্ড করা হয় ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, যা আইএমএফের তথ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
এদিকে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম অর্থপাচারকারী দেশ। অর্থপাচার রোধ করতে ব্যর্থ হলে উন্নয়নের গতি থেমে যাবে। অর্থপাচার না হয়ে অর্থনীতিতে ঘোরাঘুরি করলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়ে যায়। এর ফলে জিডিপির আকার বেড়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি এর মতে, গত ১৬ বছরে বাংলাদেশ থেকে অন্তত ১১ লাখ কেটি টাকা পাচার হয়েছে। আগামী জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে হরতাল, অবরোধসহ নানা ধরনের সহিংসতা শুরু হয়ে গেছে। নির্বাচনের পূর্বমুহূর্তে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় স্থবির হয়ে যায়। বিদেশি বিনিয়োগ কমে যায়, প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানো কমে যায়, নতুন করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কেউ বিনিয়োগ করতে চায় না, পণ্য তৈরির জন্য কাঁচামাল আমদানি কমে যায়, বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা কমে যায়। বিশেষ করে, নির্বাচনের বছরে টাকা পাচার কয়েক গুণ বেড়ে যায়। হরতাল-অবরোধের কারণে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম থেমে যায়।
এই পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক সংকটকে মোকাবিলা করার জন্য ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ নেওয়া শুরু করেছে। কর্তাব্যক্তিরা বলেছেন যে, অর্থনীতিতে সংস্কার করা শুরু হবে জাতীয় নির্বাচনের পরে। আমি মনে করি, এটা ভুল সিদ্ধান্ত। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতা যেভাবে বেড়ে চলেছে, আর দেরি না করে অর্থনীতিতে সংস্কারকাজ শুরু করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এখন থেকে অর্থনীতিতে সংস্কার কাজ শুরু না করলে রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থনৈতিক সংকটকে গভীর করবে।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক