সহিংসতাকে ‘রাজনৈতিক প্রতিবাদ’ বলল জাতিসংঘ, প্রতিবাদে বিশিষ্ট নাগরিকরা

মত ও পথ ডেস্ক

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের প্রেস ব্রিফিং বিষয়ে দেশের ৮১ বিশিষ্ট নাগরিক শনিবার বিবৃতি দিয়েছেন। তারা বলছেন, নির্বিচারে অগ্নিসংযোগ, পুলিশ হত্যা, জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারা, ভাঙচুরসহ সব ধরনের সহিংসতাকে ‘রাজনৈতিক প্রতিবাদ’-এর অন্তর্ভুক্ত করায় এই বিবৃতিটি অপরাধীদের আরও নৃশংস হতে উৎসাহিত করতে পারে।

universel cardiac hospital

বিবৃতিতে বলা হয়, গত ৩১ অক্টোবর জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিবাদ’ শিরোনামের প্রেস ব্রিফিং নজরে এসেছে। এতে উল্লিখিত কিছু পর্যবেক্ষণ তথ্যনির্ভর মনে হয়নি। এ কারণে এটি পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।

বিবৃতিদাতারা সুস্পষ্ট করে বলেছেন, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য বিচারকের বাসভবনে হামলাকারী সব দুষ্কৃতকারীকে বিএনপির কর্মী হিসেবে শনাক্ত করা হলেও জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের সেই বিবৃতিতে তার প্রতিফলন ঘটেনি।

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বিরোধী দলের কর্মীরা হামলা করেছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে’- এ ধরনের মন্তব্যে প্রকৃত অপরাধীদের পার পেয়ে যাবার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও, বিবৃতিতে হামলাকারীদের ‘যাদেরকে সরকারি দলের সমর্থক বলে মনে করা হয়’ মন্তব্য করা হয়েছে। এ ধরনের বক্তব্যের কারণে জনমনে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হতে পারে।

এতে বলা হয়, ১১ জনের মৃত্যুর খবরটি, বিশেষভাবে সহিংসতায় বিরোধী দলের ছয় সদস্য নিহত হয়েছে বলে যে দাবি করা হয়েছে তা বিভ্রান্তিকর। প্রকৃতপক্ষে ‘রাসেল হাওলাদার এবং ইমারান হোসেন’ নামে দুই গার্মেন্ট শ্রমিক একটি পৃথক ঘটনায় মারা গেছেন। অন্যদিকে জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা এবং তাকে ২৯ অক্টোবর লালমনিরহাটে বিএনপির কর্মীরা হত্যা করেছে। শামীম নামে অপর নিহত ব্যক্তি, যিনি ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশে মারা গিয়েছেন তিনি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃৃক্ত ছিলেন না বলে তার বাবা ইউসুফ নিশ্চিত করেছেন। আরেক নিহত রফিক ভূঁইয়া (৭৩), বিএনপি যাকে পুলিশের হামলায় নিহত বলে দাবি করেছে, তাঁর মেয়ে উর্মি ভূঁইয়া মিডিয়াকে জানিয়েছেন যে তার বাবা সহিংসতার মধ্যে ছিলেন না এবং রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকায় রিকশা থেকে পড়ে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে মারা যান।

বিবৃতিতে বলা হয়, পুলিশ কনস্টেবল আমিরুল হক পারভেজ ২৮ অক্টোবর পল্টনে বিএনপি সমাবেশস্থলের কাছে বর্বরোচিত হত্যার শিকার হন এবং ২৯ অক্টোবর ভোররাতে ঘুমের মধ্যে বাসের হেলপার মো. নঈমকে পুড়িয়ে হত্যা করে বিরোধী দলের বিক্ষোভকারীরা।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বিরোধী দলের কর্মী আব্দুর রশিদের মৃত্যু সম্পর্কে দেশের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি সংবাদপত্র দি ডেইলি স্টার লিখেছে, ‘বিএনপি কর্মীর নিচে পড়ে মৃত্যুবরণ’। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে বেশিরভাগ মূলধারার গণমাধ্যম জানিয়েছে, ২৯ অক্টোবর শহরের অপর প্রান্তে একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর পালানোর সময় একটি নির্মাণাধীন ভবনের ছাদ থেকে পড়ে তার মৃত্যু হয়।

যুবদলের (বিএনপির যুব সংগঠন) কর্মী জিলু আহমেদ ৩১ অক্টোবর ঢাকা থেকে প্রায় ২৩৫ কিলোমিটার দূরে সিলেটের একটি মহাসড়কে বিএনপির সহিংস মিছিলে যোগ দেওয়ার সময় তার দ্রুতগামী মোটরসাইকেল একটি গাছের সঙ্গে ধাক্কা লাগলে গুরুতর আহত হন। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

এতে বলা হয়, বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, বিল্লাল হোসেন ও রিফাত উল্লাহ বিএনপির প্রায় ১৫০০ জন উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মীর মধ্যে ছিলেন। তারা ভারি অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বেআইনিভাবে একটি সহিংস সমাবেশ করে। সমাবেশ থেকে পুলিশের ওপর আক্রমণ করা হয়। কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচরে ৩১শে অক্টোবর আনুমানিক সাড়ে আটটায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের দুজনেরই মৃত্যু ঘটে।

বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য বিচারপতির বাসভবনে নজিরবিহীন আক্রমণে গোটা জাতি স্তম্ভিত বলে জানানো হয় বিবৃতিতে। এতে বলা হয়, প্রায় ৩৫ জন সাংবাদিককে আহত করার ঘৃণ্য ঘটনাও জাতিকে উদ্বিগ্ন করেছে। আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তে ইতিমধ্যে এ ঘটনায় জড়িত মুখোশধারী ও অন্য আক্রমণকারীদের শনাক্ত করা হয়েছে এবং বিএনপির সঙ্গে তাদের সুস্পষ্ট যোগসূত্র পাওয়া গেছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে মারার এবং কুপিয়ে হত্যা করার ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, কিছু আক্রমণকারী মুখোশ পরে ছিল। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় এর অনুমান যে, মুখোশ পরা আক্রমণকারীরা ছিল ক্ষমতাসীন দলের লোক। তাদের এই অনুমান বিভ্রান্তিকর এবং বিষয়টি গভীর পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে।

উল্লেখ্য যে, সকল গণমাধ্যম ২৮ অক্টোবর ঢাকা দক্ষিণ যুবদলের (বিএনপি) সদস্য-সচিব রবিউল ইসলামের ‘প্রেস’ লেখা ভেস্ট পরে গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার ছবি ও ভিডিও সহকারে সংবাদ প্রকাশ করেছে। ব্রিফিং নোটে বলা হয়েছে, পুলিশ রড দিয়ে বিক্ষোভকারীদের উপর আক্রমণ করেছে। অথচ এর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। বরঞ্চ দেখা গেছে, আক্রমণকারীরা অত্যন্ত সহিংস হয়ে উঠলে পুলিশ বিধি মোতাবেক শুধু লাঠি, টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পুলিশের তল্লাশি অভিযান ও নির্বিচার গ্রেফতার নিয়ে অভিযোগ বিষয়ে আমরা মনে করি পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ২৮ অক্টোবর সর্বোচ্চ ধৈর্য প্রদর্শন করেছে।

বিবৃতিতে তারা বলেন, আমরা ওএইচসিএইচআর-কে অনুরোধ করছি যে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য বিচারপতির বাসভবনে হামলা, সাংবদিকদের উপর ন্যাক্কারজনক আক্রমণ, পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে মারা, সেন্ট্রাল পুলিশ হাসপাতালে ভাঙচুর চালিয়ে অগ্নিসংযোগ, কয়েক ডজন গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া, বাংলাদেশ পুলিশের সেন্ট্রাল ও বৃহত্তম পুলিশ লাইনে হামলা করা, নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে মারা ঘটনার তীব্রতা ও নিষ্ঠুরতা- এ বিষয়গুলো যেন সংঘটিত ঘটনার বিপরীতে গৃহীত ব্যবস্থা মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয়।

এতে তারা বলেন, উল্লিখিত বিষয় সম্পর্কে তথ্য ও পরিসংখ্যান আরও যাচাই-বাছাই করার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়কে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।

বিবৃতিতে স্বাক্ষরদাতাদের মধ্যে অন্যতম অর্থনীবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ড. সারওয়ার আলী, মুক্তিযোদ্ধা ও অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান, সাবেক সচিব মাসুদ সিদ্দিকী, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা, অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান, সাবেক সচিব উজ্জ্বল বিকাশ দত্ত, অভিনেতা রামেন্দু মজুমদার, অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া, রাষ্ট্রদূত আব্দুল হান্নান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাসুদুজ্জামান, সাবেক উপাচার্য ড. হারুন-অর-রশিদ, অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু প্রমুখ।

শেয়ার করুন