ফিলিস্তিনপন্থী ভারত যেভাবে মোদির সময়ে ইসরায়েলপন্থী হলো

মত ও পথ ডেস্ক

নরেন্দ্র মোদি
নরেন্দ্র মোদি। ফাইল ছবি

বিদেশের সংবাদে ভারতীয়দের তেমন একটা আগ্রহ দেখা যায় না। তবে এক মাস ধরে দেশটির গণমাধ্যমের দিকে তাকালে ঠিক উল্টোটাই মনে হবে। কারণ, এ সময়ে ইসরায়েল ও গাজার প্রতিটি সংবাদ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। সিংহভাগ সংবাদই ইসরায়েলি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনের গাজার শাসকগোষ্ঠী ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। এর পর থেকে ভারতীয় সাংবাদিকদের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরে মরুভূমি থেকে একের পর এক সংবাদ পরিবেশন করতে দেখা যায়।

এখানেই থেমে থাকেনি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো। হামাস যেভাবে হামলা করেছে, তার সরেজমিন প্রতিবেদনের পাশাপাশি নানা গ্রাফিকস ব্যবহার করে ‘হামলা মঞ্চস্থ’ করা হয়েছে। টিভি উপস্থাপকেরা যখন সংবাদ পড়ছিলেন, তখন এভাবে হামাস যোদ্ধাদের হামলাকে সচিত্রভাবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়। যুদ্ধ মাস পেরোলেও এখনো সেভাবেই কাজ করে যাচ্ছে ভারতের গণমাধ্যম। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে ইসরায়েলি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এভাবে সংবাদ পরিবেশনের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে চলমান এ সংঘাত নিয়ে দেশটির সরকারের অবস্থান বদলে যাওয়ার একটা সাযুজ্য রয়েছে। একদা ভারত সরকার যেভাবে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে, এখন তাদের সেই সমর্থন ইসরায়েলের দিকে সরে গেছে। খবর দ্য ইকোনমিস্টের।

ফিলিস্তিনের বদলে নয়াদিল্লির সমর্থন ইসরায়েলের দিকে যাওয়ার পেছনে বড় কারণ বলা হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে ভারতীয় স্বার্থ। তবে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সমর্থকদের দৃষ্টিভঙ্গি। মোদির সমর্থকেরা ফিলিস্তিনের বদলে ইসরায়েলকে সমর্থনের পক্ষে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো ইসরায়েলি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যে সংবাদ প্রকাশ করছে, তার নেপথ্য কারণ হিসেবে মোদি সমর্থকেরাও আছেন। চলতি মাসে ভারতের কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন হচ্ছে। এরপর আগামী বছর হবে জাতীয় নির্বাচন। এর আগে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর এমন অবস্থানে মোদি সরকারও স্বস্তিতে আছে।

‘গ্লোবাল সাউথ’ তথা বৈশ্বিক দক্ষিণ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর অনেকের মতো অতীতে ভারত কখনো ইসরায়েলকে সমর্থন দিলেও পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করত। তবে নয়াদিল্লি আগের সে অবস্থানে আর নেই। সাম্প্রতিককালে এর নজিরও আছে। গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। হামলার ঘটনায় এক্সে (টুইটার) দেওয়া এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ইসরায়েলে ‘সন্ত্রাসী হামলায়’ তিনি স্তম্ভিত। আরও ঘোষণা দেন, ভারত ইসরায়েলের পাশে রয়েছে।

এরপর ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে অবস্থান স্পষ্ট করতে পাঁচ দিন সময় নেয় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সাংবাদিকদের প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় বলে, দুটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ সংঘাত সমাধানের পক্ষে নয়াদিল্লি। গত ২৭ অক্টোবরের ঘটনা। গাজায় মানবিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানোর জন্য জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। তবে ভারত এ প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত ছিল। যদিও অতীতে দেখা গেছে, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন প্রশ্নে জাতিসংঘে যে কোনো প্রস্তাবে সব সময় ভোট দিয়েছে নয়াদিল্লি।

ভোটদানে বিরত থাকার কারণে দেশে বিরোধীদলগুলোর সমালোচনার মুখেও পড়ে মোদি সরকার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কারণ হিসেবে বলা হয়, হামাসের হামলার নিন্দা না জানানোর কারণে ভোটদানে বিরত ছিল ভারত। ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্য সম্পর্ক যে দিন দিন গভীর হচ্ছে, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে ভারতের অবস্থান বদল তারই প্রতিফলন। এর পেছনে ভারতকে ইসরায়েলের সমরাস্ত্র দেওয়াকে বড় কারণ মনে করা হয়।

১৯৯৯ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হয়। কাশ্মীরে এ যুদ্ধ ‘কার্গিল যুদ্ধ’ নামে সমধিক পরিচিত। এ যুদ্ধে ভারতকে সামরিক সহযোগিতা দেয় ইসরায়েল। এরপর ভারত ও ইসরায়েলের মধ্যকার সম্পর্ক গভীর হতে থাকে। এরও অনেক পরে ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সম্পর্কে স্বার্থ খুঁজে পায় যুক্তরাষ্ট্র। গত এক দশকে ইসরায়েল থেকে ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন, সীমান্ত নজরদারির জন্য সামরিক সরঞ্জাম (ধারণা করা হয় নজরদারি সফটওয়্যার, যদিও ভারত এটা স্বীকার করে না) থেকে শুরু করে অনেক সমরাস্ত্র কিনেছে ভারত। আর এর মাধ্যমে ইসরায়েলে তৈরি সমরাস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা হয়ে উঠেছে ভারত। এ সময়ে ভারতে ক্ষমতায় আছে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার। নরেন্দ্র মোদি ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ‘বন্ধুত্ব’ ভারত-ইসরায়েল এ সম্পর্ককে গভীর থেকে গভীরতর করতে সাহায্য করে।

নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী দল ও তাঁর অনুগামীরা তাদের দলের উত্থান, অর্থাৎ জনপ্রিয়তা বাড়ানোর মোক্ষম অস্ত্র ইসলামবিদ্বেষ উসকে দিতে গাজা যুদ্ধকে ব্যবহার করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, ইসরায়েলপন্থী নীতি ও এই অনুগামীদের কারণে বিদেশে মোদির ভাবমূর্তি খানিকটা ক্ষুণ্ন হলেও এটা আগামী নির্বাচনে জিততে তাঁকে সাহায্য করবে।

শেয়ার করুন