অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। গত এক সপ্তাহে আইএমএফের বিপিএম-৬ ম্যাথডের ভিত্তিতে রিজার্ভ কমেছে ১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন (১১৮ কোটি) ডলার। আর একই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদ্ধতি অনুযায়ী রিজার্ভ কমেছে ১ দশমিক ২৫ বিলিয়ন (১২৫ কোটি) ডলার।
বৃহস্পতিবার (১৬ নভেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, গত ৮ নভেম্বর আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থা বা আইএমএফের বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) ম্যাথডের ভিত্তিতে রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন। বুধবার (১৫ নভেম্বর) সেই রিজার্ভ নেমে এসেছে ১৯ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারে। যদিও ১৫ দিন আগে অর্থাৎ ১ নভেম্বর এই রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার।
অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবায়ন পদ্ধতি অনুযায়ী এক সপ্তাহ আগে অর্থাৎ ৮ নভেম্বর রিজার্ভ ছিল ২৬ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলার। আর ১৫ নভেম্বর এটি কমে দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ৭ দিনের ব্যবধানে গ্রস রিজার্ভ কমেছে ১ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার।
এর আগে ৬ নভেম্বর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসের আমদানি বিল বাবদ ১২১ কোটি ডলার পরিশোধ করে বাংলাদেশ। এর ফলে ৭ নভেম্বর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ১৯ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী চলতি বছরের ১৩ জুলাই থেকে বিপিএম-৬ নিয়মে রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন বিপিএম-৬ অনুযায়ী, দেশে রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন (২ হাজার ৩৫৬ কোটি) ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ১ নভেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গ্রস রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৬৪২ কোটি ডলার। বুধবার (১৫ নভেম্বর) এটি কমে দাঁড়ায় ২ হাজার ৫২৬ কোটি ডলার। অর্থাৎ গত ১৫ দিনে বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ কমেছে ১১৬ কোটি ডলার। অবশ্য প্রকৃত নেট রিজার্ভ এখন ১৭ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের নিচে বলে জানা গেছে। প্রকৃত রিজার্ভের এই তথ্য কেবল আইএমএফকে জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত এক বছরে রিজার্ভ কমেছে ৮ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি বা প্রায় ৯০০ কোটি ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২২ সালের ১৫ নভেম্বর গ্রস রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ৪২৩ কোটি ডলার।
এদিকে রিজার্ভ বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখা রফতানি আয়ও হোচট খেয়েছে। অর্থাৎ আগের অর্থবছরের একই মাসের তুলনায় কমেছে ১৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
সদ্য সমাপ্ত অক্টোবর মাসে মোট পণ্য রফতানি থেকে আয় গত চার মাসের মধ্যে প্রথম ৪০০ কোটির নিচে নেমেছে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, অক্টোবরে মোট ৩৭৬ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে তা ৫৯ কোটি ৪৬ লাখ ডলার বা ১৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ কম। ২০২২ সালের অক্টোবরে ৪৩৫ কোটি ৬৬ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছিল। রফতানি আয়ের এই পরিস্থিতির মধ্যে দেশে নতুন করে শুরু হয়েছে অবরোধ-হরতাল। এছাড়াও শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোকে কেন্দ্র করে অস্থিরতা তৈরি হয় পোশাক খাতে।
তথ্য বলছে, ২০২২ সালে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া পোশাকের ৪৮ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশই গেছে জোটবদ্ধ ইউরোপের বাজারে। অথচ সেখানে চলতি বছরের একই সময়ে গেছে ৪৭ দশমিক ৪০ শতাংশ। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও মোট পোশাক রফতানির হিস্যা ১৯ দশমিক ৫৭ শতাংশ থেকে ১৭ দশমিক ৭৮ শতাংশে নেমেছে। পাশাপাশি কানাডার বাজারেও এই হার ৩ দশমিক ২৬ শতাংশ থেকে নেমেছে ৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশে।
এদিকে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত চার মাসে (জুলাই থেকে অক্টোবর) ইউরোপের ২৭ দেশের মধ্যে ১২টিতে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের রফতানি কমেছে। বাকি ১৫টিতে বেড়েছে। ইইউর দেশগুলোর মধ্যে জার্মানি, স্পেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ইতালি ও পোল্যান্ডে সবচেয়ে বেশি পোশাক রফতানি হয়। ইইউর এই শীর্ষ ছয় গন্তব্যের মধ্যে শুধু জার্মানিতে রফতানি কমেছে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে বাজারে চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর সময়ে ২৫৮ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছে। এই রফতানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে ৩ শতাংশ কম।
এ প্রসঙ্গে বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বৈশ্বিক বিভিন্ন কারণে এমনিতেই দেশের রফতানি আয়ের পরিস্থিতি ভালো নেই। এর সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোকে কেন্দ্র করে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে সামনে অন্ধকার। বেশিরভাগ কারখানা তাদের সক্ষমতার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ গতিতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা আশা করছিলাম হয়তো সামনের দিনগুলোতে এটি হয়তো বাড়বে। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতিতে বিদেশি ক্রেতারাও একটু দেখে-শুনে এগোচ্ছেন।
অবশ্য রিজার্ভ বাড়ানোর আরেকটি অন্যতম উপাদান প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহে যে পতন দেখা যাচ্ছিল, অক্টোবর মাসে এই পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। অক্টোবরে দেশের রেমিট্যান্স বেড়ে দাঁড়ায় ১৯৭ কোটি ৭৫ লাখ ডলারে। এছাড়া চলতি নভেম্বর মাসের প্রথম ১০ দিনে প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে।
নভেম্বরের প্রথম ১০ দিনে প্রবাসীরা বৈধ পথে ও ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ৭৯ কোটি ৪৪ হাজার ডলার। এতে দৈনিক আসছে ৭ কোটি ৯৪ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স।
এদিকে আমদানির দায় পরিশোধ করাকে কেন্দ্র করে এখনও ডলারের বাজারে অস্থিরতা রয়েছে। দেশের ব্যাংকগুলো এখনও ঘোষণার চেয়ে বেশি দামে প্রবাসী আয় কেনা অব্যাহত রেখেছে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এখন যে পরিমাণ প্রকৃত রিজার্ভ আছে, তা দিয়ে শুধু তিন মাসের আমদানি খরচ মেটানো যাবে। সাধারণত একটি দেশের ন্যূনতম ৩ মাসের আমদানি খরচের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়।