নিষেধাজ্ঞা এলে খাদ্যনিরাপত্তায় আশঙ্কা বাড়বে, বিআইডিএসের বার্ষিক সম্মেলনে আলোচকেরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

করোনা মহামারির আগে বাংলাদেশের যে প্রবৃদ্ধি ছিল, পরে তা ধরে রাখা যায়নি। মহামারি, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের আয় কমেছে। দারিদ্র্য ও অপুষ্টির শিকার মানুষ বেড়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জাতীয় নির্বাচন ঘিরে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা। নিষেধাজ্ঞা এলে দেশের খাদ্য ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তার জন্য তা উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। একই সঙ্গে এসডিজি অর্জন আরও কঠিন হবে।

রাজধানীর একটি হোটেলে সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) তিন দিনব্যাপী বার্ষিক সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের প্রথম অধিবেশনে আজ শুক্রবার এসব কথা উঠে আসে।

‘বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধি এবং খাদ্যনিরাপত্তা’ শীর্ষক অধিবেশনে আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা বাংলাদেশের খাদ্যনীতি, ব্যবস্থাপনা, খাদ্যনিরাপত্তা, শিশুর অপুষ্টি, দারিদ্র্য, কৃষি উৎপাদনসহ বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) গবেষকেরা ভার্চ্যুয়ালি অংশ নিয়ে এসব তুলে ধরেন। ইফপ্রির তিনজন গবেষক তিনটি উপস্থাপনা তুলে ধরেন।

এই অধিবেশনে ‘খাদ্যব্যবস্থা পরিচালনা: বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত’ বিষয়ে উপস্থাপনা তুলে ধরেন ইফপ্রির জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো ড্যানিয়েল রেসনিক। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ২০১৭ সালে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নের জন্য যে অর্থনৈতিক কৌশল ঠিক করে, তাতে ২০১৭ থেকে ২০৩০ মেয়াদে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি ডলার বার্ষিক ঘাটতি দেখা যায়। করোনা মহামারি ও রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ সেই ঘাটতি আরও বাড়িয়েছে।

তিনি বলেন, এখন বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দেশটি বারবার তাগিদ দিচ্ছে। এর আগে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) কিছু সদস্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল।

বাংলাদেশ সরকার ‘ঢাকা ফুড অ্যাজেন্ডা ২০৪১’ ঘোষণা করেছে। এ প্রসঙ্গে ড্যানিয়েল বলেন, খাদ্য মন্ত্রণালয় নয়, এই অ্যাজেন্ডা ঘোষণা করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এখানেও কিছু চ্যালেঞ্জ দেখা যাচ্ছে। এ বিষয়গুলোতে কে নেতৃত্ব দিচ্ছে, এই অ্যাজেন্ডায় কীভাবে জাতীয় খাদ্য ব্যবস্থাপনা কৌশল অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, সম্পদ কীভাবে বরাদ্দ করা হবে এবং মফস্‌সল বা ছোট শহরগুলোতে খাদ্যবৈষম্য নিরসন কীভাবে করা হবে—সেগুলো নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য উল্লেখ করে ইফপ্রির এই গবেষণা ফেলো বলেন, দ্রুত নগরায়ণের কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে শহুরে জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৬ শতাংশ হতে পারে। এর অন্যতম কারণ জলবায়ুর প্রভাবে স্থানচ্যুত হওয়া। এই জনগোষ্ঠী অনানুষ্ঠানিক খাতে যুক্ত হয়; যা শহরের খাদ্যব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানের ওপরও বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে।

এই অধিবেশনে বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা–সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করা হয়। চ্যালেঞ্জগুলো হলো জলবায়ু, লিঙ্গ, জাতি, অধিকার, জবাবদিহি, রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা এবং নীতি।

সম্মেলনে ইফপ্রির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী আঙ্গা প্রদেশা ‘২০১৯ সাল থেকে বৈশ্বিক সংকট: বাংলাদেশের কৃষি খাদ্যব্যবস্থার ওপর প্রভাব’ শীর্ষক একটি উপস্থাপনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ২০২০ সাল থেকে দারিদ্র্য কমতে থাকে। তবে করোনার আগে যে প্রবৃদ্ধি ছিল, তা আর থাকেনি। ২০২০-২১ সালে করোনার কারণে মানুষের আয় কমে যায় এবং দারিদ্র্য আশঙ্কার চেয়ে বেশি হয়। ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় দারিদ্র্য আরও বেড়ে যায়। চলতি বছর বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা বাংলাদেশকে আরও পিছিয়ে দেবে বলে তিনি আশঙ্কা করেন।

আঙ্গা প্রদেশা বলেন, বাংলাদেশে ২০২২ সালে ২৮ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। এর সঙ্গে আরও ৫০ হাজার মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, ২০২২ সালে বাংলাদেশে অতিরিক্ত ৩১ লাখ মানুষ অপুষ্টির শিকার হয়। অর্থনৈতিক মন্দা চলায় চলতি বছর তা ৩৩ লাখে পৌঁছেছে।

ইফপ্রির ফোরসাইট অ্যান্ড পলিসি মডেলিংয়ের পরিচালক জেমস থারলো বাংলাদেশের কৃষি খাদ্যব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ বিষয়ে উপস্থাপনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জিডিপিতে ২৪ শতাংশ অবদান রাখে কৃষি খাদ্যপণ্য। এ খাতে কর্মসংস্থানও পুরো দেশের কর্মসংস্থানের অর্ধেক। থারলো বলেন, কৃষি খাদ্যব্যবস্থার ‘অ-খামার’ খাতে উৎপাদনশীলতা বাড়ছে। এ খাত দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। জেমস থারলো আরও বলেন, বাংলাদেশের কৃষি রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নীতিগুলোও জটিল হয়ে উঠছে। কারণ, নীতিগুলোর সঙ্গে একাধিক মন্ত্রণালয়ের যুক্ততা তৈরি হচ্ছে।

সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের প্রথম অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ইফপ্রির ডেভেলপমেন্ট স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স পরিচালক পল ডরস। উপস্থিত ছিলেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন, গবেষণা পরিচালক কাজী ইকবাল প্রমুখ। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে মোট তিনটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। কাল শনিবার সমাপনী দিনে আরও দুটি অধিবেশন, বিশেষ সেমিনার ও বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

শেয়ার করুন